ফারহানা সুলতানা
জীবনানন্দ দাশ, তিরিশের দশকের অন্যতম আধুনিক কবি। জীবনানন্দ দাশকে আমরা কবি হিসেবেই জানি এবং পাঠ করি। কিন্তু তাঁর যে আরো কিছু পরিচয় থাকতে পারে, নানা শৈলীতে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, প্রায় অজানাই থেকে যেত যদি না তাঁর মৃত্যুর পর চারটি ট্রাঙ্ক আবিষ্কৃত হতো। কবিতার পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস।
‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ কথাটি বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিকদের মুখে মুখে। গদ্য ভাষায় রচিত এ বাক্যটি জীবনানন্দ দাশের কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার কথা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রথম প্রবন্ধের প্রথম বাক্য। মূলত কবি হিসেবে পরিচিত থাকলেও তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রকৃত পা-ুলিপি আমাদের জানায়, কত বিচিত্র তার সৃষ্টিকর্ম। রচনা করেছেন দুহাজারের বেশি কবিতা, গল্প, উপন্যাস। অথচ প্রকাশ করেছেন মাত্র ১৬৬টি কবিতা।
জীবনানন্দের মৃত্যুর পর, তাঁর বেশ কিছু সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর ছবির প্রয়োজন হয়। সে সময়ে ছবি খুঁজতে গিয়েই আবিষ্কৃত হয় চারটি ট্রাঙ্ক, যা ছিল গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধের পা-ুলিপিতে পরিপূর্ণ। তাঁর রচিত গল্প-উপন্যাস পরবর্তী সময়ে চার খ-ের সমগ্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। ফলে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, কেন তিনি এসব সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করলেন না। যতদূর জানা যায়, কবি জীবনানন্দ যে নব্য ধারায় কাব্য রচনা করেছেন তা তৎকালীন সময়ে যথেষ্ট সমালোচিত ছিল। জীবনানন্দ দাশ মানুষের অন্তর্গত বেদনা, হতাশা, ব্যর্থতা, নৈঃসঙ্গবোধকে এক বিমূর্ত কল্পলোকে অনুভব করেছেন এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নাগরিক জীবনে একাকী মানুষের ব্যর্থতায় মূল সংকট প্রতিভাত করেছেন। এর মূলে তিনি যৌনতাকে উল্লেখ করেছেন। যার ফলে ব্যক্তিজীবনে বারংবার হোঁচট খেয়েছেন। এমনিতেই তিনি ছিলেন অন্তমুখী। তাঁর ওপর তৎকালীন সাহিত্যিকদের তীব্র কটাক্ষের বিপরীতে নিশ্চুপ থেকেছেন জীবনানন্দ দাশ। চাকরিতে, শিক্ষকতায় এমনিতেই মন বসাতে পারতেন না। তার ওপর কবিতার অশ্লীলতার দায়ে চাকরিচ্যুত হওয়া। প্রায়ই বেকার থাকার কারণে ব্যক্তিজীবনে দাম্পত্যজীবনে জীবনানন্দ অসুখীই ছিলেন। শিল্পের সঙ্গে আপস করতে না চাইলেও অবস্থার চাপে পড়ে কখনো দিশেহারা হয়েছেন।
জীবনানন্দ পতœী লাবণ্য দাশের গ্রন্থের মাধ্যমে জানা যায়, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, কাব্যজগতে যদি তিনি সম্মান না পান তবে তিনি উপন্যাস রচনা করবেন। আর যদি তাঁর কাক্সিক্ষত আসন কাব্য দিতে পারে তবে উপন্যাস, গল্প কখনোই আলোর মুখ দেখবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি জীবনানন্দ অনুভব করেছিলেন যে তাঁর কাব্য প্রতিষ্ঠা পাবেই? যদি বুঝে থাকবেন তবে এ হতাশা কেন? অতএব বোঝা যায় যে, প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ভেবেই উপন্যাস, গল্পকে আড়াল করেননি। এর পেছনে রয়েছে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত মন।
জীবনানন্দ যে শান্তি নাটোরের বনলতা সেনের কাছে চেয়েছেন সেই আবদার আধুনিক মানুষ, সমাজ, কবি, সাহিত্যিক এমনকি লাবণ্য দাশ সহজভাবে নেননি। প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। তাই হয়তো নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে চাননি জীবনানন্দ দাশ। কবিতায় যা রহস্যময় তার গল্প-উপন্যাসে তা স্বচ্ছ, নিরেট, নগ্নভাবে প্রকাশিত। প্রশ্ন জাগতে পারে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের জীবন, আবহমান প্রেম কোনো কিছুই কেন জীবানন্দের হতাশা ঘোচাতে পারলো না। কিভাবে চেয়েছেন জীবানন্দ দাশ উত্তর মেলে তাঁর গল্প-উপন্যাসে। গল্প-উপন্যাসে তিনি যে বার্তা দিতে চেয়েছেন তা হলো মানুষের জীবনে মূল্যবান হলো টাকা। মানুষের মন নামক স্বত্ব সেখানে বিক্রীত। টাকাই মানুষের সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। সব মানুষ ভালো থাকতে চায়। এর উৎস টাকা। কেবলই টাকা। কিন্তু জীবানন্দ দাশ এ জীবনে সুখ পাননি। তাই মানুষের পৈশাচিক ব্যবহার, অবহেলাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। আধুনিক নাগরিক জীবনের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা অযথাই লক্ষ্যহীন জীবনকে বয়ে চলার আনন্দে তিনি আনন্দিত হতে পারেননি। না ছিল তার বহুরূপী মুখোশ, না ছিল টাকা। তাই সমাজে তার অবস্থান ছিল হতাশাগ্রস্ত, কাপুরুষ, নির্জনতম ব্যক্তি। প্রকৃত পক্ষে কেউই তার ভেতরকার সত্তাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারেননি।
জীবনানন্দ দাশ গদ্যরচনায় হাত দেন কাব্য রচনাকালের বছর পাঁচেকের মধ্যে। তা ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে।
কয়েক বছরেই রচিত হয়ে যায় ‘কারুবাসনা’, ‘জীবনপ্রণালী’, ‘প্রেতিনীর রূপকথা’, ১৯৪৮ সালে ‘মাল্যবান’, ‘জলপাইহাটি’, ‘সুতীর্থ’, ‘বাগমতীর উপাখ্যান’। আগেই আমরা জেনেছি, জীবনানন্দ তাঁর গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করতে চাননি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে তবে লিখলেন কেন? বাস্তবতা হচ্ছে ‘ক্যাম্পে’ কবিতা রচনার জন্য চাকরিচ্যুত হওয়া, নব্যধারার কবিতার দুর্বোধ্যতার জন্য সমসাময়িক কবি, সমালোচকের জাতীয় রোষানলের স্বীকার হওয়া। এসব ঘটনা তার ব্যক্তিজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। পরিচয় পত্রিকায় সুভাষ মুখোপাধ্যায় কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এসব কারণে তাঁর ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেছেন জীবনানন্দ।
সৃষ্টিশীল জীবনানন্দ নিজের আবেগ-অনুভূতিকে দমিয়ে রাখলেও তাঁর রচনাকর্মে তাকে প্রকাশ করেছেন। আধুনিক প্রগতিশীল সমাজের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের পাশে অসহায়, শান্ত তথাকথিত অবসাদগ্রস্ত মানুষদের মনোবেদনা, আত্মকথা, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত, নারী-পুরুষের আবেগের ভিন্নধর্মী মাত্রা তুলে ধরেছেন। বর্তমান সময়ে নারী-পুরুষে যে ভাঙনের সুর প্রায় স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে তার উত্থান কিন্তু তখনই ঘটেছিল। সেই অস্বাভাবিকতাকেই তুলে ধরতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। দূরদর্শী জীবনানন্দ মানুষের জীবনের গভীরতর সংকটকে বুঝতে পেরেছিলেন। বর্তমান সময়ে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা এতটাই বিপন্ন যে, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক শৃঙ্খল কোনোভাবেই আর নিজস্বতা বজায় রাখতে পারছে না। একটা সময় ছিল যখন নারীরা পুরুষের ওপর সর্বাংশে নির্ভরশীল ছিল। বিদ্যার অভাব, সাহসের অভাব যাই বলি না কেন, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধার-ভালোবাসার। আজ সেখানে সবাই সবার প্রতিপক্ষ যেন। এ বিষয়গুলোই ফুটে উঠেছে জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে।
জীবনানন্দের প্রথম উপন্যাস ‘কারুবাসনা’। নামকরণটি জীবনানন্দ করেননি। তাঁর উপন্যাসের একটি বিশেষ শব্দকে পরবর্তী সময়ে নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। কারুবাসনা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র কাব্যপ্রেমিক বেকার হেম ও তার স্ত্রী কল্যাণী। দেশের বাড়িতে থাকে, অভাবের সংসার। হেম কোনোভাবেই সংসারে সচ্ছলতা আনতে পারে না।
সংসারে আরো আছে বাবা-মা, পিসি। প্রত্যেকেই যার যার মতো আলাদা, একা। এই একাকী মানুষগুলোর কথাই নানা সংলাপ আত্মকথনের মাধ্যমে উঠে এসেছে। হেম শেষ চেষ্টারূপ শহরে আসে; কিন্তু নাগরিক সভ্যতায় সে ক্রমশ হাঁপিয়ে ওঠে। উপন্যাসের সংলাপ ছাড়াছাড়া, আবেগের তীব্র অভাব রয়েছে। আধুনিক ব্যক্তি মানসের বিপর্যস্ত রূপই তার কারণ। মনের গহিনে আবেগের তীব্র স্রোত বইলেও ভাবে, ভাষায় তা প্রকাশ্য নয়। এখানেই তো আধুনিক মানুষ অসহায়। যা সে চায় তা প্রকাশ করা যায় না, যা বাস্তবে ঘটছে তা যেন কাক্সিক্ষত নয়। এ কারণেই সর্বত্র দ্বিধার রাজত্ব। আজন্ম লালিত শেকর সন্ধানী মানসিকতা যেন ক্রমশ খসে পড়ছে। তাই পুত্র হেম আত্মহত্যার কথা বললে মা বলেন ‘কিন্তু এ তো কোন সম্ভবপর কিছু কথা নয়।’
জীবনানন্দকে বিশ্লেষণ করতে চাইলে একটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে, তিনি আধুনিক ছিলেন। তাঁর আধুনিক জটিল মানসক্রিয়া ভিন্নধর্মী উপমা, ভাবকল্পনায় প্রকাশিত হয়েছে। এ উপন্যাসে কাহিনী গতিময়তা, চরিত্র নির্মাণে কিছু জড়তা থাকলেও ‘মাল্যবান’-এ এসে তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক। এ উপন্যাস একটি দাম্পত্য জীবনের ছবি। এখানে প্রকৃতার্থেই জীবনানন্দ আধুনিক হতে পেরেছেন। ব্যক্তি মানুষের অসহায়ত্ব, জীবন নিয়ে খেলা, আপস করার কৌশলকে দেখে তা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। তার চেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করে তার রচিত ‘মাল্যবান’ উপন্যাসের মাল্যবান নামক চরিত্রটি। আড়াইশ টাকা মাইনে পাওয়া মাল্যবানের আর্থিক সামর্থ্য কম; কিন্তু মাল্যবান তার স্ত্রী উৎপলা ও সন্তান মনুকে সুখে রাখতে চায়। কিন্তু আধুনিকা উৎপলা চায় জৌলুস। তাই মাল্যবান ছিটকে পড়ে। উৎপলা বাড়ির ওপরের ঘরে ভালো কক্ষে আরামে থাকে। সেখানে মাল্যবানের স্থান হয় না। মাল্যবানকে জীবন কাটাতে হয় বাড়ির নিচের তলার কক্ষে ইঁদুরের সঙ্গে। উৎপলার কাছে আনন্দ করা, পার্টি করা, সিনেমা দেখা, পার্কে ঘুরে বেড়ানোই জীবনের নাম। দামি শাড়ি পরার মধ্যেই সে শান্তি পেতে চায়। মাল্যবান উৎপলার এ দাবি মেটাতে পারে না। এক সময় উৎপলা মাল্যবানের সামনেই গ্রহণ করে সমরেশকে।
এখানে জীবনানন্দের সৃষ্টিশীল চেতনার ক্রমপরিবর্তন লক্ষণীয়। নিত্য অভাবে রোগাক্রান্ত কল্যাণী হেমের সঙ্গে সুখী নয়। তবু সে আপস করেছে ভাগ্যের সঙ্গে, জীবনকে বয়ে বেড়িয়েছে। পরবর্তী সময়ে মাল্যবান উপন্যাসে জীবনানন্দ যেন সে দায় এড়াতে চাইছে। যেন কল্যাণীর যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করেই উৎপলা-সমরেশ আখ্যানের অবতারণা।
জীবনানন্দের উপন্যাসে সংঘাত আছে, গভীর জীবনদৃষ্টি আছে। এ সংঘাত সমাজের সঙ্গে নয়, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির নিজের অস্তিত্বের সংঘাত। তাই মাল্যবান, উৎপলা, হেম, কল্যাণী সবার বেদনাই পৃথক, অস্তিত্বের সংকটও ভিন্ন। তাদের একাকিত্ব, বেদনার গভীরতা প্রকাশ করতে গিয়ে জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ অংশ উহ্য রয়ে গেছে। প্রায়ই জীবনানন্দের উপন্যাসের নায়কেরা বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা। কিন্তু এ সন্তানেরা উপন্যাসে উপেক্ষিত। দৈনন্দিন জীবন, নারী-পুরুষের কর্মময় জীবনের ছবি, আবেগী-সংসারী মনোভাব এখানে অনুপস্থিত। এ যেন কেবল থাকার জন্যই থাকা। তাঁর সৃষ্ট নায়কেরা আরামে থাকতে চায়, স্ত্রীসঙ্গ চায়। কিন্তু তারা উদ্যমী নয়। প্রতি উপন্যাসেই লেপের উষ্ণতার আড়ালে জীবনের গভীরতর স্বাদের প্রসঙ্গ এসেছে। সংকটের মূলে দারিদ্য। এর ফলেই মাল্যবান-উৎপলা, হেম-কল্যাণী, স্বামী-স্ত্রী হয়েও সর্বদাই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছে। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের মূলে আর্থিক সঙ্গতিকেই গুরুত্ব দেন তিনি। তাই জীবনসায়াহ্নে এসেও উৎপলার সচ্ছল মেজদা-বৌঠান সুখী। অন্যান্য উপন্যাসেও এই প্রবণতা স্পষ্ট। এ ধারা থেকে কিছুটা বের হয়ে আসেন ‘সুতীর্থ’ উপন্যাসে। সুতীর্থ মাল্যবান বা হেমের মতো নয়। সে ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট। তারপরও মানুষের অন্তর্গত বেদনাকে তিনি একইভাবে অনুভব করেছেন। সুতীর্থকে তিনি প্রাণশক্তি দিয়েছেন; কিন্তু বৈরীবিশ্বেও নোংরা বোধের চক্রে তা নিয়ত দ্বিধাগ্রস্ত।‘জলপাইহাটি’ সেদিক থেকে কিছুটা প্রতিবাদী। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিশীথ সেন, মধ্যবিত্ত। স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে জলপাইহাটি গ্রামে বাস করে। স্ত্রী সুমনা রোগাক্রান্ত। জীবিকার তাগিদে নিশীথ সেন শহরে আসে। মফস্বলের গ-ির বাইরে জীবনকে খোলা চোখে দেখতে গিয়ে, সমাজের, রাষ্ট্রের বড় ফাঁকি চোখে পড়ে তাঁর। উপন্যাসের কিছু অংশ তুলে ধরছি…
‘ছেলে, অধ্যাপক বা গভর্নিং বডিগুলোকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। দোষ বাংলা-দেশের বিশ শতকের ভেতরে যে ধ্বংসের কীট রয়েছে দিনের পর দিন তার শ্রীবৃদ্ধির। মাস্টারদের কোনো বন্ধু নেই আজ। ছেলেরা গ্রাহ্য করে না : খুব সম্ভব কম মাইনে পায় বলে; গভর্নিং বডি চোখ উল্টে কথা বলে : খুব সম্ভব কম মাইনে দিয়ে এইসব নিরীহ তালকানাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এত সহজ, এত চমৎকার বলে। …একজন ওস্তাদ বাবুর্চি বা মোটর ড্রাইভার যে টাকা পায়, ইউনিভার্সিটির একজন লেকচারার যদি তার চেয়ে কম পায়, তাহলে সাধারণ স্কুল-কলেজের মাস্টাররা কি পায়, কি খায় সেদিকে কি নজর পড়বে না মার্কসিস্ট বা কংগ্রেসি বিপ্লবীদের?’
এ ভাষা কিন্তু হতাশার হতে পারে না। অর্থাৎ আমরা দেখছি যে উপন্যাসে চরিত্রের মাধ্যমে জীবনানন্দের চিন্তার বিবর্তন ঘটছে। জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে। তাঁর অধিকাংশ নায়ক বেকার, প্রায়ই এক সন্তানের পিতা, স্ত্রী রোগাক্রান্ত, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক শীতল, অভাবের আনাগোনা সর্বদাই। স্ত্রীকে রোগাক্রান্ত দেখিয়ে স্বামীর চেতন-অবচেতন মনের নানা ভাবকল্পনা ধীরলয়ে বর্ণিত হয়েছে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক যে, ঔপন্যাসিক এখানে সর্বদর্শী ভূমিকা নেন না। কেবলমাত্র পুরুষ চরিত্রের অন্তর্গত বেদনা এখানে উপস্থিত। নারী চরিত্রেরও নিজস্ব কিছু বেদনা থাকতে পারে, যা এখানে নেই। স্ত্রী রোগাক্রান্ত না হলে কি ঘটতো তাও বোঝা যায় না। আমরা উপন্যাসের ধারায় একে নতুন একটি রীতিরূপে দেখতে পারিÑ যেখানে সমাজবিচ্ছিন্ন মানুষের একান্ত কথা আছে। বর্তমানকালে প্রতিটি মানুষই সুখী হওয়ার অভিনয় করে মাত্র। প্রকৃতপক্ষে স্বামী-স্ত্রীর যে আবেগ, অনুভূতি তা সংসারজীবনের কয়েক বছরেই পানসে হয়ে যায়। সেখানে স্থান পায় সামাজিক দায়বদ্ধতা।
জীবনানন্দের অন্যান্য সব উপন্যাসেই এমনকি গল্পে এ ধরনের যন্ত্রণাময় দাম্পত্য জীবনের ছবি এসেছে। যেখানে মাল্যবানের মতো সাধারণ স্বামীর আবেগ, অনুভূতি, চাওয়া মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। সম্ভবত এসব কারণেই জীবনানন্দ দাস উপন্যাস প্রকাশ করেননি।
জীবনকে, দাম্পত্য জীবনকে তিনি এক উৎকট রূপে প্রত্যক্ষ করেছেন। কখনো মনে হয়েছে হয়তো প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিজীবন এমনই আবার পরক্ষণেই এ নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছেন। যে সংকট নিজে অনুভব করেছেন সেটা এতটা খোলামেলা প্রকাশিত হোক তা হয়তো চাননি জীবনানন্দ দাশ। বর্তমান সময়ে এ উপন্যাসগুলো পাঠে কখনোই শিল্পমান বর্জিত গদ্যসম্ভার বলে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এখানে জীবনের গভীরতা আছে। আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সংকট আছে। অনেকে বলতে পারেন, সংকট থেকে উত্তরণের পথ জীবনানন্দ দেখাতে পারেননি। তাদের বলতে চাই জীবনানন্দ মানুষের বোধকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন। জাগ্রত ব্যক্তি মাত্রই আপন কর্তব্য অনুভব করতে পারবেন। যদি পারা যায় তবে কথাশিল্পী জীবনানন্দের সার্থকতা।
[ad#co-1]
Leave a Reply