‘দেবদাস’ প্রসঙ্গে চাষী নজরুল ইসলাম

চাষী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস নির্ভর সর্বাধিক সংখ্যক ছবির পরিচালক। তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তিনটি উপন্যাস নিয়ে চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। আশির দশকের শুরুর দিকে তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর উপন্যাস ‘দেবদাস’ চিত্ররূপ দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সম্প্রতি তিনি নতুন করে দেবদাস তৈরি করেছেন। নিজের সৃষ্টির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাকে তৈরি করতে হয়েছে আলোচ্য এই ছবিটি। দুই দেবদাস নির্মাণ প্রসঙ্গে ‌‌ ‘বক্স অফিস’ পত্রিকার পক্ষ থেকে চাষী নজরুল ইসলাম এর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন কাজী হাসান :

কাজী হাসান : আপনি আশির দশকের গোড়ার দিকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ‘দেবদাস’ ছবি তৈরি করেছিলেন। আবার সমপ্রতি কাজ শেষ করলেন নতুন ‘দেবদাস’ এর। একই উপন্যাস অবলম্বনে আবার ছবি তৈরি করলেন কেনো?
চাষী নজরুল ইসলাম : মজার ব্যাপার হলো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘দেবদাস’ বারো বার চিত্রায়িত হয়েছে। পৃথিবীতে কোনও উপন্যাসই এখন পর্যন্ত বারো বার চিত্রায়িত হয়নি। ‘দেবদাস’ আরও কতবার হবে আমি জানিনা। এর মূল কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে ‘শাশ্বত প্রেম’। পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার বেদনা যেমন তীব্র তারচেয়ে বেশি আনন্দেরও। ‘দেবদাস’ চরিত্রটি তৈরি করেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আরো অনেক গল্প ও উপন্যাস তাঁর আছে। শরৎচন্দ্রের অনেক লেখাই আমি পড়েছি। ‘দেবদাস’ এ আমাদের সে সময়কার সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটি তিনি তুলে ধরেছেন। শ্রেণী বৈষম্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু এর সমাধানের জন্য তিনি দিক নির্দেশনা দেন নি। তার লেখা পড়ে চরিত্রগুলো কত পরিচিতি মনে হয়। মনে হয় প্রেক্ষাপট যেন আমাদের আশে পাশেরই। চরিত্রগুলো আমাদের পরিবারের লোক, আপনজন। সমাজটা যেন আমাদের চির চেনা। সমস্যাগুলো এমন চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন, মানুষ পড়লেই আবেগে আপ্লুত হন। যার জন্য শরৎচন্দ্র চট্টোপধ্যায় এতো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। তিনি একজন প্রকৃত কথাশিল্পী। অমর কথাশিল্পী বললে একজনকেই বোঝায়, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখা ও সংলাপ পড়ে কাঁদতে হয়। তার লেখা পড়ে মনে হয় যেনো আমিই বলছি। যেনো আমার মা-বোন বলছে। যেনো আমার বাবা বলছে। এতো চমৎকার সংলাপ আমি আজ পর্যন্ত কারও লেখায় পাইনি। ‘দেবদাস’ উপন্যাসটি আমি পড়ি ছোটবেলায়। উপন্যাসটির প্রতি আমার ভীষণ দুর্বলতা ছিল। তখন স্বপ্ন ছিল সিনেমার নায়ক হবো। পরবর্তীতে নায়ক না হয়ে হলাম চিত্রপরিচালক। ছবি নির্মাণ যখন শুরু করলাম, প্রায়ই ভাবতাম আমি যদি সুযোগ পাই ‘দেবদাস’ উপন্যাস অবলম্বনে ছবি করবো।

‘দেবদাস’ এ কি যেনো একটা রয়েছে। ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা। শুধু আমি নই যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, দেবদাস প্রসঙ্গে কথা উঠলেই বলেন কান্না পায়। সেই আবেগটা আমার মনেও কাজ করেছে। সেই স্বপ্ন থেকেই আমি প্রথম ১৯৮০ সালের দিকে ‘দেবদাস’ ছবিটি করি। আরেকটি কথা আমি স্পষ্টভাবে বলবো, চলচ্চিত্রটা তো একটা ব্যবসাও বটে, বাণিজ্যও বটে। অনেকে মনে করেন বানিজ্য নয়। আমি বলি শিল্পমাধ্যম তবে বাণিজ্যও বটে। তো চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এমন গল্প নির্বাচন করতে হবে, যে গল্পের চিত্ররূপ দেখতে মানুষ সিনেমা হলে যাবে। তাহলে যে অর্থ লগি্ন করা হলো তা ফেরত আসবে। এই দু’টো বিষয়কে সমন্বয় করি আমি। এমন ছবি বানাবো-জনগণ দেখবে। আর জনগণ দেখলে অর্থও ফেরত আসবে। অর্থ ফেরত পেলে আমি আবার ছবি তৈরি করতে পারবো। আমি নিজেকে মেইনস্ট্রিম ছবির একজন পরিচালক মনে করি। আমি আর্ট মুভি, তথাকথিত বিকল্পধারা_এসবে বিশ্বাসী নই। ছবি ভালো আর মন্দ_এ দু’ধরনের হতে পারে। তো ‘দেবদাস’ যখন বানাই তখন বুলবুল আহমেদকে ‘দেবদাস’ চরিত্রে নিই। আমাকে তখন অনেকে বলেছেন বুলবুল আহমেদকে তো বয়সে বড় মনে হচ্ছে। উপন্যাসে তো আছে দেবদাসের বয়স ঊনিশ কি কুড়ি। উন্নত ললাট। ব্রাক্ষণ। জমিদার পরিবারের সন্তান। বুলবুল আহমেদের দেহের গড়ন দেখলে জমিদারের মতোই মনে হয়। বাস্তবিকই তো বুলবুল আহমেদ সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। লম্বাটে, উন্নত ললাট এবং বয়স ৪০। কিন্তু গল্পে ছিল ঊনিশ কি কুড়ি। কিন্তু আমি ‘দেবদাস’ নিয়ে যতোগুলো ছবি দেখেছি, ‘দেবদাস’ চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের সবাই ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সে অভিনয় করেছেন। এর কারণ একটা আছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংলাপ যেভাবে লিখেছেন। যে সংলাপগুলো দেবদাস বলছে তা ঊনিশ বছরের কোন ছেলে বলতে পারে না। মানে আমরা বলতে শুনিনি বা শুনি না।। খুব ম্যাচিউরড ডায়লগ। ওই ম্যাচিউরিটিটা আসেই কিন্তু ৩৫/৪০ বছর বয়সে। সে জন্যেই প্রত্যেক ‘দেবদাস’ চরিত্রে রূপায়নকারীর বয়স ৪০/৪৫ ছিল। আর ওই সংলাপগুলো তো বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ হতে হবে, মানাতে হবে। আর নাহলে বলবে ইঁচড়ে পাকা। যথার্থ বয়সের কেউ ওই সংলাপ বললে বলবে সঠিক লোক।

পার্বতী চরিত্রে ভাবলাম কবরীকে। আমরা তখন বলতাম কবরী কাঁদলেও এক লাখ টাকা হাসলেও এক লাখ টাকা। চন্দ্রমুখী চরিত্রে নিলাম আনোয়ারাকে। ও নৃত্যশিল্পী। পৃথিবীর প্রথম ভাষা ছিল নৃত্যের মাধ্যমে। নৃত্যই তাই প্রথম শিল্প। নৃত্য থাকলে সংলাপের প্রয়োজন নেই। কারণ মুদ্রা ও এঙ্প্রেশন দিয়ে ভাব প্রকাশ করা যায়। তাই নৃত্যশিল্পীরা ভালো আর্টিস্ট হতে পারেন। আনোয়ারা অত্যন্ত উঁচুমানের অভিনয় শিল্পী। বহু ভালো ভালো ছবিতে সে অভিনয় করেছে। নিঃসন্দেহে সে আমাদের দেশের গর্ব। চন্দ্রমুখী বাঈজীর চরিত্র। আনোয়ারাকে কাস্ট করলাম। রহমানকে নিলাম চুনিলাল চরিত্রে। আমি রহমান সাহেবের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও, ভীষণ আপনজন ছিলাম আমরা। তাঁকে আমি খুব কাছে থেকে পরখ করেছি। তিনি মদ্যপান করতেন। কিন্তু দেখে কেউ বলতে পারবেন না তিনি মদ্যপান করেছেন। তিনি বলতেন, আমরা কেনো মনে করি মদ খেলেই মাতাল হতে হবে। এই যে, চুনিলালের চরিত্র, যে বাঈজীপাড়ার যায়। সে মদ্যপান করে। আবার নিজের কাছে সে অটল, স্থির। তার চিন্তায়, ধ্যান-ধারণায় একটু বিচু্যতিও ঘটেনা।

এছাড়াও গোলাম মুস্তাফা, রওশন জামিল, সুমিতা দেবী, রাণী সরকারকে নিয়েছি। আমি চেয়েছি, ছবিটাতে কমার্শিয়াল একটা ফ্লেভার আসুক। উপন্যাসকে ছবি করলে একটা রিস্ক থাকে। আমার তাই ভাবনায় ছিলো এতো বড় দক্ষ কলাকুশলী নিয়ে ছবি করলে আমি হয়তো মার খাবো না।

পরবর্তীতে ‘দেবদাস’ ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়।

তারপর দীর্ঘদিন অনেক ছবি করেছি। একবার ‘ঈশা খাঁ’ নামে একটি ছবি নির্মাণের বিষয় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। চিত্রনাট্য করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। ফরিদুর রেজা সাগরকে আগেই ছবিটি করার ইচ্ছের কথা আমি জানিয়ে ছিলাম। সে বলেছিল, করেন। সবকিছু প্রায় চূড়ান্ত। শুটিং এ যাবো। সেই মুহূর্তে ঈশা খাঁ চরিত্রের শাকিব খান আমাকে বললো, স্যার এটা পরে করেন। আমি বললাম, তাহলে আগে কি করবো?

‘দেবদাস’ করেন।

আমি বললাম, আমি ‘দেবদাস’ করেছি তো?

শাকিব বললো, আবার করেন। আমি আপনার দেবদাস দেখেছি। আমার যে শিডিউল ‘ঈশা খাঁ’র জন্য দেয়া আছে। সেই শিডিউলে ‘ঈশা খাঁ’ না করে ‘দেবদাস’ করেন।

আমার লোভ আগেই ছিলো। করেছি একবার। আমি বললাম, করবো? দাঁড়া তাহলে একজনকে জিজ্ঞেস করে নিই। আমি বুলবুল আহমেদকে ফোন করলাম। বললাম, আমি ‘দেবদাস’ ছবিটা আবার করতে চাই। কেমন হবে?

শুনে বুলবুল আহমেদ বললেন, এই চাষী, আপনি খেপেছেন?

আমি বললাম কেনো? হলো কি?

তিনি বললেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছেন। ফাস্ট ডিভিশন পেয়েছেন। আবার পরীক্ষা দেবেন কেনো?। যদি আপনি খারাপ করতেন তাহলে না হয় ঠিক হতো।

আমি বললাম দেই না আবার। অনেক সময় দেখেন না ডাবল এম.এ করেছে কেউ কেউ।

তখন তিনি বললেন, তাহলে করেন।

এরপর শাকিব খানকে আমি বললাম, কর। তবে আমার প্রডিউসারকে তো জানতে হবে। ইমপ্রেস টেলিফিল্মকে জানালাম। যে যাই বলুক মনের দিক থেকে ফরিদুর রেজা সাগর হানড্রেড পার্সেন্ট শিল্পী। যার মা শিল্পী, বাবা শিল্পী সাগার যাবে কোথায়? সাগর শুনে বললো, করেন। আর্টিস্ট কে?

আমি বললাম, শাকিবকে নেবো ‘দেবদাস’ চরিত্রে। মৌসুমী চন্দ্রমুখী, পার্বতী পূর্ণিমা।

সাগর বলল, ঠিক আছে। কাজ শুরু করেন।

তারপর কোনও এক কারণে পূণিমার সঙ্গে মিললো না। তাকে রাখা গেল না। আমার পরিচালনায় ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ৩টি ছবিতে এর আগে পূর্ণিমা অভিনয় করেছে। কেনো পূর্ণিমা ‘দেবদাস’ এ থাকলো না তা বলছি-

রাগ নয়, অভিমান করে আমি তাকে ‘দেবদাস’ এ নিলাম না। কেউ যদি প্রশ্ন করেন এখন, আমার সাথে তার কিসের অভিমান, তো তার সঙ্গে তো আমার প্রেম নেই? অভিমান তার সঙ্গে করা যায় যার ওপর অধিকার থাকে। তাহলে আমি কিসের অভিমান করতে পারি? তুমি আর্টিস্ট আমি ডিরেক্টর, শিল্পী হিসেবে তোমার সাথে আমার একটা ভালো সু-সম্পর্ক আছে। একটা আন্তরিক স্নেহের জায়গা আছে। সেই কারণে তোমার কাছে আমার চাওয়াটা ছিলো। তুমি সেটাকে অস্বীকার করলে। চাওয়াটা কি? অর্থকড়ির ব্যাপরটা। সেখানে আমার কাজ শুনে তুমি আমাকে হঁ্যা বলবে। তোমার ব্যাপারটা তো আমি দেখবোই। মজা করে আমরা একে অপরের ডার্লিং বলে ডাকি। আমি তাকে ‘দেবদাস’ এর পার্বতী চরিত্র করার অফার দিয়েছি। শুনে সে বলবে, কবে থেকে? আমি ডেটটা মিলাই_এটা আমি তার কাছ থেকে আশা করেছিলাম। এটা তার কাছে আমার চাওয়া ছিল।

কিন্তু সে তা না করে সরাসরি টাকার কথা বললো। শুনে আমি শক্ড্। একটা পর্যায়ে টাকা ফিঙ্ড হলো। তারপর সে বললো, তাকে একসঙ্গে সব টাকা দিতে হবে। শুনে আমি আরও শক্ড্ হলাম। এর আগে সে আমার তিনটি ছবি করেছে। কোনওটার টাকা সে পায়নি এমন তো নয়। কম-বেশি হতে পারে।

আমার মন তেমন একটা সায় দিল না। মনে হয় তাকে বেশি আপন ভেবে ফেলেছি। বললাম, পূর্ণিমাকে বাদ দাও। এরা ডেডিকেটেড শিল্পী নয়। এরা ফিল্মে এসেছে পয়সা কামাতে। পয়সা যেমন সব শিল্পী নেয় আবার এমন অনেকে আছে যারা পয়সা নেয়ও না। অনেক প্রমাণ আছে। রাজ্জাক আছে। শাকিব খান আছে। ফারুক আছে। সুচন্দা আছে। দশ জায়গা থেকে তো কামাচ্ছি। এক জায়গা থেকে কামাবো না। যতটুকু পারা যায় মনের ক্ষুধা মেটাবো। যাই হোক কারও জন্য কোন কাজ থেমে থাকে না। পার্বতী চরিত্রে পরে অপু বিশ্বাসকে নিলাম। নতুন ‘দেবদাস’ এর শুটিং হলো। তবে অনেক সময় লেগে গেলো। এই জীবনে ৩০টার মতো ছবি করেছি। তার কোনওটি শেষ করতে আমার এতো সময় লাগেনি। এর কারণ শিল্পীর সময়। শিডিউল। শাকিব খানের ব্যস্ততা।

আমার ছবিতে শাকিব খান অভিনয়ের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলো। অন্য ছবিতে দেখা গেছে সে দিনে ৫/৬ টি সিকোয়েন্স করছে আর আমার ছবিতে দেখা গেলো একটি সিকোয়েন্সই হয় নি। সকাল ১০/১১ টায় এসে রাত ৮/৯ টায় কাজ শেষ করেছে ঠিকই। আবার রাত ১ টা পর্যন্তও কাজ করেছে। কিন্তু আউটপুট তেমনভাবে হয়নি। ও চেষ্টা করেছে যতটুকুই হয় যেনো ভালোভাবে হয়। এই সিনসিয়ারিটির কারণেই আমি অন্য ছবির মতো এ ছবির কাজ দ্রুত শেষ করতে পারিনি। যার জন্য সময় বেশি লেগেছে। দেখা গেলো একটি কাজ করতে হয়তো লাগবে একদিন। কিন্তু লাগলো তিনদিন। এই করে সম্পূর্ণ ছবি করতে গিয়ে ছবির বাজেট, সময়_সব ফেল করলো। ছ’মাসের একটা প্রোজেক্ট। সেই প্রোজেক্ট যদি শেষ করতে দু’আড়াই বছর লেগে যায় তাহলে কি দাঁড়াবে? পুরো সময়টা আমাকে কিন্তু ফুল ইউনিটটাকে পালতে হয়েছে। কস্টিং বেড়েছে। তারপরও শাকিব খানের এসিস্ট্যান্ট সেদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিল, স্যার আপনি খুব লাকি। পুরো ছবিতে আপনার একটি দিনও শুটিং প্যাকআপ হয়নি। অন্য ছবিতে দেখা গেছে ৭/৮ দিন শুটিং প্যাকআপ হয়েছে। হয় বৃষ্টির জন্য, নয় হিরো টাইমলি পেঁৗছাতে পারেনি নয় হিরো এসেছে কিন্তু হিরোইন আসতে পারেনি।

শেষের দিনে ছিল গরুর গাড়িতে শুটিং। দেখা গেল আকাশ কালো করে ঝড় আসার লক্ষণ। আমি মনে মনে বললাম, আহ, আজ শেষ দিনে ধরা খেয়ে গেলাম। মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপর আকাশ পরিষ্কার। সারারাত শুটিং হয়েছে। রাত তিনটার দিকে শাকিব খান বললো, স্যার সকাল বেলায় বটগাছের সিকোরেন্স শুটিং শেষ করে যাবেন কিন্তু। আমি থাকবো। আপনি এখন ফুল ইউনিট সেখানে পাঠিয়ে দিন। আমি ঠিক সাড়ে ৪টার মধ্যে ওখানে উপস্থিত থাকবো। ভোর যখন হবে হবে তখন আপনি একটা শট নেবেন।

আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা সব ইউনিট গেলাম। কি যে কষ্ট! কাঁচা রাস্তা, কাঁদা। আমরা তো পেঁৗছলাম। কিন্তু হিরো কি আসতে পারবে? রাস্তায় প্রচণ্ড কাঁদার মধ্যে হিরো এক পর্যায়ে তার গাড়ি থামিয়ে রিক্সা, ভ্যানে চড়ে বসলো। সেই ভ্যান চারজনে ধাক্কাচ্ছে আর একটু করে এগুচ্ছে। এটেল মাটি। পা দেবে গেলে ওঠানো মুশকিল। পুবাইলে শালাইকা বোধ হয় গ্রামটির নাম। ঠিক সাড়ে চারটায় ওই কোয়াটার মাইল পথ কাঁদা পেরিয়ে শাকিব খান লোকেশনে পেঁৗছে শট দেয়। শুটিং শেষ হয় ভোর সাড়ে ছ’টায়। শুটিং শেষে ও বলে, স্যার যাইগা?

আমি বললাম, যা।

আবার তাকে রিক্সা ভ্যানে তুলে তার গাড়ি পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে যাওয়া হলো। একটি ভ্যান তরি-তরকারি নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল।

ও ভ্যানওয়ালাকে বললো, আমি তোমার সব তরি-তরকারি কিনলাম। জালি কুমড়া, লালশাকসহ নানারকম তরকারি। তারপর ইউনিটের আনোয়ারকে বলে, আমাকে ভ্যানে তোল। সেই কাঁদাময় পথে তাকে গাড়ি পর্যন্ত যেতে হলো। ইউনিটের চারজন লোক ঠেলে নিয়ে গেলো। শাকিব খান তো এতো পরিশ্রম করে ছবি করার কথা না। ওই যে বললাম শিল্পীর ক্ষুধা কিন্তু থাকে। না হলে সে হয়তো বলেই বসতো, এতো কষ্ট করে আমি যাবো না। সম্ভব নয়।

আমাদের সঙ্গে ছিল পরিচালক সমিতির সভাপতি মহম্মদ হাননান। সে গাড়োয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছে। শাকিব খান শিল্পী সমিতির সভাপতি। আমার টেকনিশিয়ানরা মজা করে বলছিল, দুই সমিতির সভাপতিকে আজ শান্টিং দেন।

আমি বললাম, কারেক্ট। দুই সভাপতিকে আজ শান্টিং দেয়া হবে। এমন হাসি-ঠাট্টা করে আমরা সারারাত কাজ করেছি।

এভাবে শেষ পর্যন্ত ছবিটা শেষ করলাম। এখন ডাবিং ও এডিটিং বাকি। খুব শীঘ্রই এই কাজগুলো শেষ করবো। আশা করি সেপ্টেম্বরে ছবিটি রিলিজ করতে পারবে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।

প্রমথ বড়ুয়াও ‘দেবদাস’ দু’বার তৈরি করেছেন। একবার বাংলায়। আরেকবার হিন্দিতে। বাংলায় নিজে নায়ক। হিন্দিতে সায়গল।

কাজী হাসান : আগের ‘দেবদাস’ আপনি করেছিলেন পরীক্ষিত সব শক্তিমান কলা-কুশলী নিয়ে। ছবিটি বেশ প্রশংসিত ও ব্যবসা সফল হয়েছিল। দ্বিতীয় বার ‘দেবদাস’ করতে গিয়ে আপনার প্রথম ‘দেবদাস’ কি আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

চাষী নজরুল ইসলাম : আমার কাছে প্রতিদ্বন্দ্বী বার বার মনে হয়েছে। বার বার মনে হয়েছে আমি আগের ‘দেবদাস’ এর কাছে এই ‘দেবদাস’ নিয়ে পরাজিত হচ্ছি।

যেমন বলি, ক্যামেরা। আমার কাছে মনে হয়েছে আমি যা চেয়েছি, যেভাবে চেয়েছি, তখন যে ক্যামেরাম্যান দিতে পেরেছে এই ক্যামেরাম্যান তেমনভাবে দিতে পারেনি। তখন ক্যামেরাম্যান ছিলেন এম এ মোবিন আর এই ‘দেবদাস’ ছিলেন লাল মোহাম্মদ। অনেকে হয়তো বলবেন বর্তমান ‘দেবদাস’ এর কাজ বেশি ভাল হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে আনোয়ারা নেই। আমার কাছে মনে হয়েছে কবরী নেই। নেই বুলবুল আহমেদ, রহমান। যে যতো কথাই বলুক এটাই সত্যি। একটি পিতার ৪/৫টি সন্তান থাকতে পারে। কিন্তু প্রথম সন্তানের প্রতি দুর্বলতা বেশি থাকে। কারণটা হলো প্রথম পিতা হওয়ার অনুভূতি হয় প্রথম সন্তানের আগমনের মধ্য দিয়ে। আবার প্রথম সন্তানের নামের মধ্য দিয়েই তার পিতৃত্বের পরিচয় অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন ‘অমুকের বাপ’। আর প্রথম সন্তান যে আদর সোহাগ পায় তা কি পরবতর্ী সন্তানদের ক্ষেত্রে সমান্তরালভাবে হয়? আমার প্রথম সন্তান আগের ‘দেবদাস’ আর দ্বিতীয় সন্তান এই ‘দেবদাস’।

কাজী হাসান : আগের ‘দেবদাস’ ছবির কোনও অপূর্ণতা বা ব্যর্থতা কি এই ছবিতে পূরণ করেছেন?
চাষী নজরুল ইসলাম : কিছুটা করেছি। যেমন গল্পের প্রেজেন্টেশন। তবে উপন্যাস হুবহু ঠিক রেখেই। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে আমি সংযোজন-বিয়োজন করেছি। প্রথম ‘দেবদাস’ এর মতো করে আমি এই দেবদাস শুরু করিনি। আমি পরিণত ‘দেবদাস’কে দিয়ে শুরু করেছি। শেষ দৃশ্যে একটা কাজ করেছি। এটা কোনও ‘দেবদাস’ এ আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।

‘দেবদাস’ মারা যাবার আগে গরুর গাড়ির মধ্যে শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে ঠোঁট কাঁপছে। অস্পষ্টভাবে তার মুখ দিয়ে ‘পারু’ শব্দটি বেরিয়ে আসছে। পারুকে ডাকছে। সে পারুর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল মৃতু্যর আগে একবার হলেও সে পারুর গ্রামে যাবে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যই সে সেখানে গেছে। অন্তিম সময়ে সে পারুর কাছাকাছি এসেছে। বলছে, পারু আমি এসেছি। ঠিক তখন পারু যে ঘরে শুয়েছিল তার দরজা-জানালা সশব্দে খুলে গেল। সে সাই করে উঠে বসলো। একটা প্রদীপ কেঁপে কেঁপে জ্বলছিল। সে প্রদীপের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ দেবদাসের আত্মাটা পারুর ঘরে চলে এসেছে। বলছে, পারু আমি এসেছি। এর পর পরই ‘দেবদাস’ মারা গেলো গরুর গাড়িতে।

কাজী হাসান : আগের ‘দেবদাস’ এর গানগুলোই কি ব্যবহার করেছেন?
চাষী নজরুল ইসলাম : না। এ ছবিতে তিনটি গান লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকউজজামান। ওই ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ দুইটি গানই কিন্তু তিনি লিখেছিলেন। বাঈজী চন্দ্রমুখীর মুখে যে দু’টি গান। এই একই দৃশ্যে আবার নতুন করে তার গান লিখতে হয়েছে। যা তার জন্য খুব টাফ হয়েছে। তিনি অসাধারণ গীতিকার। তার গানে কবিতা থাকে, কাব্যময়তা থাকে। গানের সুর করেছে ইমন সাহা। আগের ছবিতে সুর করেছিলেন খন্দকার নূরুল আলম। ইমন সাহাকে বললাম, গান কাকে দিয়ে গাওয়াবি ঠিক কর।

নতুন ছেলে মেয়ে যারা সেরাকণ্ঠ বা ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যারা এসেছে তাদের কাউকে নেবো? আমি বললাম ‘গাওয়া’।

আমার কাছে ১৫ দিনের সময় নিলো। হয়তো সে ট্রাই করেছে। আমি জিজ্ঞেস করিনি। ১৫ দিন পর বললো, না আংকেল হবে না।

আমি বললাম, কেনো?

না আংকেল আমি চেষ্টা করেছি। হবে না।

আমি বললাম ওরা যে ফাস্ট, সেকেন্ড হয়েছে।

ও বললো, এগুলো অন্য কথা। এই গান ওরা গাইতে পারবেনা আংকেল, রুনা আন্টি, সাবিনা আন্টিকে দিয়েই গাওয়াবো।

তো এরপর রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীনকে ডাকলাম। দু’জন একসঙ্গেই এসেছিল। একদিনে রেকর্ডিং হয়েছিল। ইমন ওদের শুনিয়েই বলেছিলো, আংকেল আঠাশ বছর পরে আর একটা রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন পেলাম না এই গান গাওয়ার জন্য। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।

আমি বললাম, অবশ্যই।

আরেকটি গান গেয়েছে বাপ্পা মজুমদার ও শাকিলা জাফর। এটা নতুন সংযোজন। ওই গানটি লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আগের ‘দেবদাস’ এ তার গান ছিল না। বাপ্পা মজুমদারকে দিয়ে আমিই প্রথম প্লে ব্যাক করাই। সে আমার ‘সুভা’ ছবির মধ্য দিয়েই প্রথম ফিল্মে গান করে। আমার কাছে ওর কণ্ঠটা আলাদা, মিষ্টি মনে হয়। আর ও ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক জানে। আমি ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ওপর দুর্বল বলেই গরুর গাড়ির গানটা কিন্তু আমি গাইয়েছি সানী জুবায়েরকে দিয়ে। আগের ‘দেবদাস’ এ গেয়েছিল সুবীর নন্দী। গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। অসাধারণ গায়ক সানী জুবায়ের। শুটিং দেখতে গিয়েছিল কণ্ঠশিল্পী রবি চৌধুরী। গান শুনে খুব প্রশংসা করছিল। ও জিজ্ঞেস করলো, ভাই ভয়েসটা কার? আমি বললাম, সানী জুবায়েরের।

এই জন্যেই তো এতো চমৎকার!

আমিই ইমনকে বললাম, এই গানের জন্য একজন সিঙ্গারের কথা বলবো? এর আগেই ইমন বললো, আংকেল আমি একজনের নাম বলি, সানী জুবায়ের। আমি বললাম, আরে কি করে মিলে গেলো! সানী জুবায়েরকে রেকর্ডিং এ ডাকা হলো। সানী জুবায়ের যখন দু’তিনবার গানটি গাইলো। শুনে বললাম, তুই আমার পাশে বস, আমি এঙ্প্রেশন দেবো। তুই গাবি। ইমন ট্র্যাক ছাড়লো। এরপর সে আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে ফিল্মিক ব্যাপারটা ধারণ করলো। এসব কারণে নতুন ‘দেবদাস’ এ একটু ভিন্নমাত্রা তো আছেই।

আমি বলতে চাই আমি কোনও আর্ট ফিল্ম বানাইনি। সোজা ভাষায় একটি বিনোদনমূলক ছবি বানিয়েছি।

কাজী হাসান : প্রথম দেবদাস এর শেষ লোকেশন কোথায় ছিলো?
চাষী নজরুল ইসলাম : রাজেন্দ্রপুর। রেল স্টেশনকে বানিয়েছিলাম ‌’পান্ডুয়া’। আর এ ছবিতে পুবাইলকে বানিয়েছি ‘পান্ডুয়া’। ইংরেজি ও হিন্দিতে ‘পান্ডুয়া’ লেখা হলো। আমি বললাম, একটা গ্যাড়াকলে ফেলে দিলাম। ট্রেন যখন আসবে তখন ভড়কে যাবে ট্রেন ড্রাইভার। কনফিউজ্ড হয়ে হয়তো বলবে এ কোথায় এলাম?

বললাম, স্টেশনে গণ্ডগোল লাগার আগে তাড়াতাড়ি শট নে।

কাজী হাসান : প্রথম ‘দেবদাস’ ছবিতে প্রযোজক কে ছিলেন? আর নতুন দেবদাস এর?
চাষী নজরুল ইসলাম : প্রথম ছবিতে মুখ্য প্রযোজক ছিলাম আমি। সঙ্গে দু’জন

পার্টনার ছিলেন। আর এখন ইমপ্রেস টেলিফিল্ম।

কাজী হাসান : এ পর্যন্ত যতগুলো ‘দেবদাস’ চিত্রায়িত হয়েছে তার মধ্যে আপনার ভালো লেগেছে কোনটি?
চাষী নজরুল ইসলাম : দিলীপ কুমার অভিনীত বিমল রায়ের দেবদাস আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। বিমল রায় উপন্যাস থেকে সরে দাঁড়াননি। সঞ্জয় বানসালী তো দেবদাস বানাননি। তিনি শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছেন। পরে অবশ্য তিনি বলেছেন মূল থিম নিয়ে তিনি তার মতো ‘দেবদাস’ বানিয়েছেন।

কাজী হাসান : ছবি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
চাষী নজরুল ইসলাম : অনেক কিছুই মাথায় ঘোরে। এগুলো বলে লাভ নেই। সময় এবং অর্থ দু’টোরই প্রয়োজন। দু’টোর যখন সমন্বয় হবে তখনই কিন্তু কিছু করা যাবে।

তথ্যকণিকা

আগের দেবদাস :
দেবদাস : বুলবুল আহমেদ
পার্বতী : কবরী
চুনিলাল : রহমান
চন্দ্রমুখী : আনোয়ারা
পার্বতীর মা : রানী সরকার
দেবদাস এর মা : সুমিতা দেবী
দেবদাস এর বাবা : আরিফুল হক
ক্যামেরাম্যান : এম এ মোবিন
সংলাপ, চিত্রনাট্য : কেশব চট্টোপাধ্যায়
মুক্তি : ১৯৮২ সাল
নির্মাণ ব্যয়: ১৩ লক্ষ টাকা
সঙ্গীত পরিচালক : খন্দকার নূরুল আলম
কণ্ঠশিল্পী : রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, সুবীর নন্দী
গীতিকার : মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান

বর্তমান দেবদাস :
দেবদাস : শাকিব খান
পার্বতী : অপু বিশ্বাস
চুনিলাল : শহীদুজ্জামান সেলিম
চন্দ্রমুখী : মৌসুমী
পার্বতীর মা : শিরীন বকুল
দেবদাস এর মা : লীনা আহমেদ
দেবদাস এর বাবা : আহমেদ শরীফ
ক্যামেরাম্যান : লাল মোহাম্মদ
সংলাপ, চিত্রনাট্য : কেশব চট্টোপাধ্যায়
মুক্তি : ২০১১ সাল
নির্মাণ ব্যয় : দেড় কোটি টাকা
সঙ্গীত পরিচালক : ইমন সাহা
কণ্ঠশিল্পী : রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, বাপ্পা মজুমদার, সানী জুবায়ের, শাকিলা জাফর
গীতিকার : মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার

চাষী নজরুল ইসলাম এর পোর্ট্রেট : ইফতেখার ওয়াহিদ ইফতি

সূত্রঃ কাজী হাসান

Leave a Reply