পার্থ সারথি দাস
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন অনিশ্চিত_এর পরও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বিকল্প অর্থায়নের ব্যাপারে দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না সরকার। প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে কানাডা পুলিশ ও বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন। তবে এই তদন্ত কবে শেষ হবে, তদন্ত শেষ হলে এর প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক মেনে নেবে কি না, মানলে প্রতিশ্রুত অর্থ মিলবে কি না_এ সবই এখনো অনিশ্চিত।
বিশ্বব্যাংক পিছু হটায় প্রকল্পে অন্য তিন ঋণচুক্তিকারী এডিবি, জাইকা ও আইডিবি ঋণচুক্তি অনুযায়ী অর্থায়ন করার বিষয়ে নীরব রয়েছে। এ কারণে মহাজোট সরকারের ২৯৭ কোটি ইউএস ডলারের এই বড় প্রকল্প নিয়ে সরকার প্রশ্নের মুখে রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলে সরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপির) ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলেছে। কিন্তু পিপিপির ভিত্তিতে বিনিয়োগের জন্যও বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত বিশেষভাবে আগ্রহ দেখায়নি।
মাওয়া-জাজিরা স্থানে প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ঢাকতে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ স্থানে দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর জন্য তড়িঘড়ি করে গত ৩ নভেম্বর প্রাকযোগ্যতার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। তাতেও কোনো সাড়া নেই।
এই অবস্থায় নতুন দায়িত্ব পাওয়া যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বারবার আশ্বাস দিলেও পদ্মা সেতু প্রকল্পের কুয়াশা সহসাই কাটছে না। যোগাযোগমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর গত শনিবার প্রথমবারের মতো মাওয়া প্রান্তে গেলে তিনি পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট ঘনকুয়াশা কেটে যাওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নিয়মিতভাবেই বলছেন, এ সরকারের সময়ই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা হবে। ঠিক একইভাবে প্রতিশ্রুতি দিতেন তাঁর স্থলে আগে দায়িত্বে থাকা সৈয়দ আবুল হোসেনও।
সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে প্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে এমনিতেই এই সময়ের মধ্যে তা নির্মাণ সম্ভব হতো না। দুর্নীতির অভিযোগে এখন অনিশ্চিত অবস্থায় নতুন যোগাযোগমন্ত্রী বলছেন এ সরকারের সময় কাজ শুরু করে দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এ নিয়েও বিশেষজ্ঞরা সংশয়ে আছেন।
এ ব্যাপারে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বলা হচ্ছে পিপিপির মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া মাথায় রাখতে হবে। চুক্তির পর প্রথম দিকে সরকার ও বিনিয়োগে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক শর্ত পূরণ করতে হয়। কিন্তু বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে আলোচনার টেবিলে আনতেই বছরখানেক পার হয়ে যাবে। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া মানেই সময়ক্ষেপণ। বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিও বিবেচনায় রাখতে হয়। এই অবস্থায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে তো এখনো আগ্রহী বিনিয়োগকারীর নাম শোনা যায়নি। তাহলে তো এখনো প্রকল্পটি কুয়াশায় ঢাকা। তবে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এক্ষেত্রে সমঝোতা হলে কুয়াশা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের তদারকি পরামর্শক হিসেবে কানাডার এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা বিবেচনা করে বিশ্বব্যাংকের অনুমতির জন্য পাঠানো হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক এতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতে কানাডা পুলিশ বিষয়টির তদন্ত করছে। মূল সেতুর প্রাকযোগ্যতা যাচাই দরপত্রে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে যাচাইবাছাই প্রক্রিয়ায়ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে বিশ্বব্যাংক। এ দুটি বিষয়ই তদন্ত করছে দুদক।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্ত কবে শেষ হবে, তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে এই দুটি অভিযোগের বিষয়ে দুদকের দুটি অনুসন্ধান চলছে। আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এসব অনুসন্ধানের প্রাথমিক প্রতিবেদন তৈরি হতে পারে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক ও সেতু তৈরির জন্য ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে গত ২০ ডিসেম্বর সাবেক যোগাযোগ (বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সৈয়দ আবুল হোসেন দুদকের কাছে জবানবন্দি দিয়েছেন। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্তের জন্য যেসব তথ্য দরকার তারা আমার কাছ থেকে সেসব তথ্য জেনেছেন। আমি সত্য বলেছি। আমার দায়িত্ব পালনকালে এই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আপনারা সময় হলেই সব সত্য জানতে পারবেন। আমি মাওয়া-জারিরা ও পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ দুটি স্থানেই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য সব যত দ্রুত সম্ভব করেছি। আমার কারণে কাজ পিছিয়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা সত্য নয়।’
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত ডিজাইন অনুযায়ী, এ প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৯৭ কোটি ডলার। সেতুটি নির্মাণে বিশ্বব্যাংক ১৫০ কোটি, এডিবি ৬১ কোটি ৫০ লাখ, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ পর্যন্ত সেতুর ব্যয় চার দফা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রথম যখন দেশের সবচেয়ে বড় এই নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৪০ কোটি ডলার। শেষ পর্যন্ত এ সেতুর নির্মাণ ব্যয় আরো এক দফা বেড়ে ২৯০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ যাবৎ প্রকল্পে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
কালের কন্ঠ
Leave a Reply