জীবনবিবর্তনের কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন

আহমাদ মাযহার
রাবেয়া খাতুনের লেখা পড়ছি সেই ছোটবেলা থেকে। বাড়িতে ঈদসংখ্যা বেগম পত্রিকা আসত মাঝে মাঝে। বেগম পত্রিকাতেই তাঁর ছবি দেখেছিলাম প্রথম। সুমন ও মিঠুর গল্প নামে একটা ছোটদের বই আছে তাঁর। শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত শিশু পত্রিকার ঈদসংখ্যায় কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে পড়েছিলাম গল্পটি। মনে দাগ কেটেছিল। ছোটদের উপযোগী ভাষায়, তাদের জন্য লেখা ওই গল্পটি একইসঙ্গে পরিণত মনেরও সামগ্রী। সমাজের গভীরে যে ভাবস্রোত বিরাজ করে তাকে যে রাবেয়া খাতুন টের পান তা বিশ বছরেরও বেশি সময় পরে পুনর্পাঠে অনুভব করেছিলাম। রাবেয়া খাতুনের শিল্পযাত্রায় সমাজের বিবর্তন লক্ষণীয়। তা যেমন তাঁর পরিণতজনদের কথাসাহিত্যে তেমনই ছোটদের জন্য রচনাতেও। পঞ্চাশেরও বেশি উপন্যাসের রচয়িতা রাবেয়া খাতুন রচিত এ-যাবৎকাল পর্যন্ত সংকলিত ছোটগল্পের সংখ্যাও চারশো ছাড়িয়েছে অনেক আগেই, সংখ্যায় ছোটদের জন্য লেখা গল্প-উপন্যাসেরও সংখ্যা প্রচুর। এসব রচনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবন বিবর্তনের রূপই ধরা পড়েছে।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস মধুমতীতে (১৯৬৩) ধরা পড়েছে গ্রামসমাজ ও নাগরিকসমাজের পরিবর্তমানতা। ক্ষয়িষ্ণু তাঁতি সমপ্রদায়ের জীবন সংকটের সঙ্গে নাগরিক উঠতি মধ্যবিত্ত জীবনের জিজ্ঞাসা উন্মোচিত হয়েছে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু এমন একটা সময়ে যখন ঢাকা অঞ্চলের মানুষ অবস্থান করছিল আধুনিকতা ও গ্রামীণতার সন্ধিক্ষণে। ঢাকাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে তিনি গ্রামজীবনের শিথিল সম্বন্ধকে ধরে রেখেছেন উপন্যাস ও ছোটগল্পের আধারে। সে-সময় পুরনো ঢাকা কাঠামোগত দিক থেকে নগর হয়ে উঠলেও গাঢ় হয়ে ওঠেনি তার যথার্থ নাগরিক জীবন। তবে এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে গ্রামের জীবনযাত্রার ছিল বিস্তর পার্থক্য। সে-কালের গঠমান সমাজমানসে ক্রিয়াশীল ছিল যে চেতনা-প্রবাহ তার অনেক অন্তরঙ্গ ছবি উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে ও গল্পে। পুরনো ঢাকার সেই স্বাতন্ত্র্যকে রাবেয়া খাতুন স্বচ্ছভাবে তুলে আনতে পেরেছিলেন রাজাবাগ (১৯৬৭), বায়ান্নো গলির এক গলি (১৯৮৪) কিংবা সাহেব বাজার (১৯৬৯) প্রভৃতি উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধ তাঁর সংবেদনশীলতাকে বারবার নাড়া দেয় বলেই বারবার তাঁর গল্প-উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ উপজীব্য হয়। নয় মাসের অবরুদ্ধ দিনগুলোর দিনলিপিও একদিকে হয়ে ওঠে সহৃদয়হৃদয়সংবেদ্য সাহিত্য, অন্যদিকে প্রামাণ্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধকালের পরিস্থিতি বাংলাদেশের মানুষের জীবনবোধকে কিভাবে বিবর্তিত করেছে তার পরিচয়ও খুঁজে পাই আমরা তাঁর কথাসাহিত্যে!

আধুনিক চিকিৎসা-শাস্ত্র অধ্যয়নের ইতিহাস বেশি পুরনো নয়। প্রাকৃতিকতায় নির্ভরশীল হেকিম-কবিরাজদেরই কদর ছিল সমাজে। রাবেয়া খাতুনের মোহর আলীরাই সেই ধারার শেষের প্রজন্ম। মোহর আলী (১৯৮৫) উপন্যাসে সমাজের অপসৃয়মাণ সে জীবন বোধকে ধরে রাখা হয়েছে। আবার সাম্প্রতিক জীবনধারাকেও তিনি ধারণ করেন সজীবতায়। দূরে বৃষ্টি (২০০৩), ঠিকানা বি এইচ টাওয়ার (২০০৫), কুয়াশায় ঢাকা নগর বধূ (২০০৩), রমনা পার্কের পাঁচ বন্ধু (২০০৩) ইত্যাদি উপন্যাসে বিশ্বায়ন কবলিত নগরজীবনের সংকট ও স্বপ্নকে বা স্বপ্নভঙ্গকে ধারণ করেছেন। এখানেও মূর্ত হয়েছে বিবর্তিত জীবন।
যে প্রত্যাশা বিশ শতকের চলি্লশ-পঞ্চাশের দশকের বাঙালি মুসলমান সমাজকে উজ্জীবিত করেছিল তার পতন থেকেই ঘটেছিল বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সূচনা। গণতন্ত্রের প্রত্যাশায়, অধিকার অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হয়েছিলাম আমরা। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পেয়েছিলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কিন্তু যে ধর্মকেন্দ্রিক চেতনা পাকিস্তানকে ধ্বংস করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল তা ছদ্মবেশে রয়েই গেল। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনো চলছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটির মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধকেই বহাল রাখার কথা বলা হয়। রাবেয়া খাতুন এই চেতনায় উজ্জীবিত লেখক বলেই প্রথম বধ্যভূমি (২০০৪) উপন্যাস লেখেন ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে, ফেরারী সূর্য (১৯৭৫), ঘাতক রাত্রি (১৯৯৯), হিরণ দাহ (১৯৯৫), বাগানের নাম মালনিছড়া (১৯৯৫), হানিফের ঘোড়া (১৯৯৫) লেখেন মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলো নিয়ে।

মধুমতীকে ঠিক বিশুদ্ধ গ্রামীণ উপন্যাস বলা যায় না। উঠতি মধ্যবিত্ত মনের রোমান্টিক চেতনাও এতে ক্রিয়াশীল ছিল। তুলনায় বরং পল্লীজীবনের বিবর্তনকথা তিনি বলেছেন ইভাদর মাহ ভাদর (১৯৮৮) উপন্যাসে। তাঁর স্বামী প্রয়াত ফজলুল হক চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিনেমা নামে চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা, যখন বাংলাদেশে চলচ্চিত্রেরও সূচনা ঘটেনি। সেখানে কর্মসূত্রে এবং নিজের উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ লাভের সূত্রে তিনি চলচ্চিত্র-জগতেরও মানুষ। সেই সুবাদে এই জগতের মানুষদের সম্পর্কে অনেক কাছে থেকে জেনেছেন। ফলে তিনি লিখে ফেলতে পারেন রঙিন কাচের জানলা (২০০১) বা কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৪) উপন্যাস। আসলে রুপালি পর্দার জীবনের অন্তরালে তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের ব্যক্তিক সংকটকেই উন্মোচন করেন এবং ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজের জীবন উপলব্ধিকে প্রকাশ করেন।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখা তাঁর ছোটগল্পগুলোকে যথার্থ নান্দনিক মাত্রা বিচারের মাধ্যমে নির্বাচন করা হলে হয়তো তাঁর মধ্যে আরো শক্তিমান একজন গল্পকারকে শনাক্ত করা সম্ভব। সমালোচনা সাহিত্যের দীনতায় রাবেয়া খাতুনদের মতো লেখকদের সৃষ্টিশীলতার গতিপ্রকৃতিকে অনুসরণ করে দেখা হয়নি।

গৃহকোণবাসী বাঙালি মুসলমান সমাজে তীর্থযাত্রা বলতে ছিল বিত্তশালীদের হজ। কিন্তু সে যাত্রারও সমৃদ্ধ ভ্রমণকাহিনী নেই তেমন একটা। বিশ শতকের মধ্যভাগে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রার সূত্রে দেশভ্রমণ করলেও তাঁদের হাতে ভ্রমণসাহিত্য গড়ে উঠতে পারেনি। ব্যতিক্রমী রাবেয়া খাতুন ভ্রমণ শুধু ভালোই বাসেন না, ভালোবাসেন তার আনন্দ ও উপলব্ধিকে পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। ভ্রমণসাহিত্য রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করেছেন বলে তাঁর এই আঙ্গিকের বইও অনেকগুলো। হে বিদেশী ভোর (১৯৯০), মোহময়ী ব্যাংকক (১৯৯১), টেমস থেকে নায়েগ্রা (১৯৯৩), কুমারী মাটির দেশে (১৯৯৪), হিমালয় থেকে আরব সাগরে (১৯৯৯), কিছুদিনের কানাডা (২০০০), চেরি ফোটার দিনে জাপানে (২০০১), কুমারী মাটির দেশ অস্ট্রেলিয়া (২০০৪), মমি উপত্যকা এবং অন্যান্য আলোকিত নগর (২০০৫) তাঁর উল্লেখযোগ্য ভ্রমণসাহিত্য। আরো অনেক লেখা পত্র-পত্রিকার পাতায় ছড়িয়ে আছে, অপেক্ষায় আছে বই হয়ে প্রকাশের জন্য। এসবের মধ্য দিয়েও আমরা পাই জীবনবিবর্তনের রূপকে!
সরাসরি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী না লিখলেও আত্মজৈবনিক স্মৃতিমূলক রচনা লিখেছেন। একাত্তরের নয় মাস-এ (১৯৯০) লিখেছেন একাত্তরের শ্বাসরুদ্ধকর দিনগুলোর কথা। স্মৃতিকথায় নিজের কথা নয়, নিজের হয়ে ওঠায় যে-সব মানুষের প্রভাব ও ভূমিকা রয়েছে তাঁদের কথা বলেছেন। স্বপ্নের শহর ঢাকা (১৯৯৪), স্মৃতির জ্যোতির্ময় আলোয় যাঁদের দেখেছি (২০০৫), চোখের জলে পড়ল মনে (২০০৮) বইয়ে নিজের ব্যক্তিজীবন নয়, পরিবারের ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল যে-সব ব্যক্তির সানি্নধ্য পেয়েছিলেন তাঁদের মমতাময় ছবি পাওয়া যায়।

আপনা আপনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালির চিরকালের লোক-সংস্কৃতির সম্পদকে রাবেয়া খাতুনের সহজাত প্রতিভা নিয়েছে আত্মস্থ করে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ও জসীমউদ্দীন নির্দেশিত পথে চলা রাবেয়া খাতুনের শিশুসাহিত্যের মাধুর্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। কথকতার সৌন্দর্যকে তিনি যেমন রূপকধর্মী গদ্যে হাজির করতে পারেন তেমনি নিপুণতায় বাঙ্ময় করতে পারেন আধুনিক নগরজীবনের বিবর্তমান শিশুমনস্তত্ত্বকেও। তিনি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীরও লেখক, দুঃসাহসিক অভিযান (১৯৬৭) যার নিদর্শন। নগরজীবনের পটভূমিকায় লেখা সুমন ও মিঠুর গল্প তো আধুনিক ক্ল্যাসিকই হয়ে উঠেছে। ছোটদের জন্য লেখা একাত্তরের নিশান (১৯৯২) উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি উপস্থিত রয়েছে। ইতিহাসের ঘটনা মানুষের মধ্যে জীবনবোধের বিবর্তন ঘটায় তার পরিচয় রয়েছে ছোটদের জন্য লেখা তাঁর তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা (১৯৮১) উপন্যাসে।

জীবনের অভিজ্ঞতায় ক্রমশ সমৃদ্ধিমান নিরন্তর সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল বলে এখনো তাঁকে বিবর্তমান বলা চলে। দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন হোক তাঁর; বিবর্তমান জীবনের শিল্পসৃষ্টিতে তাঁর কলম থাকুক সর্বদা সচল।

জী ব ন স ং ক্ষে প
নাম : রাবেয়া খাতুন
পিতা : মৌলবি মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ
মা : হামিদা খাতুন
স্বামী : চিত্রপরিচালক ও সাংবাদিক এটিএম ফজলুল হক
সন্তান : ২ ছেলে_ ফরিদুর রেজা সাগর, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও শিশুসাহিত্যিক এবং ফরহাদুর রেজা প্রবাল, আর্কিটেক্ট ও এক সময়ের জনপ্রিয় উপস্থাপক (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী)। দুই মেয়ে_ রন্ধনবিদ কেকা ফেরদৌসী ও ফারহানা কাকলী
জন্ম : ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫, পাউসার, বিক্রমপুর
ভাইবোন : ১ ভাই ৩ বোনের মধ্যে দ্বিতীয়
কর্মজীবন : প্রথম জীবনে শিক্ষকতা এরপর প্রায় ৭-৮ বছর সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে লেখালেখির সঙ্গেই তার বসবাস
প্রথম প্রকাশিত বই : মধুমতি

ডেসটিনি

Leave a Reply