মোস্তাক চৌধুরী
যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। মাথার উপর শরতের সুনীল আকাশ। নিবিড় বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাকা সরু রাস্তা। এই পাকা সরু রাস্তাই আপনাকে নিয়ে যাবে বজ্রযোগিনী গ্রামে। আসলে বজ্রযোগিনী গ্রাম, এটি একটি ইউনিয়ন। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় বজ্রযোগিনী গ্রামটি অবস্থিত। মাঝে মধ্যে দেখতে পাবেন পানের বরজ, কাশ ফুলের ঝাড় আর ডোবা নালা। সে এক মনোরম দৃশ্য। অতীশ দীপঙ্করের স্মৃতিবিজড়িত বজ্রযোগিনী গ্রাম। বজ্রযোগিনী গ্রামের নামকরণ নিয়ে কিছুটা মতান্তর রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট শেরশাহের যুদ্ধের সময় পরাজিত এক হিন্দু রাজা বরজ নামে এক মেয়েসহ এই গ্রামে বসবাস করতে আসেন। এই মেয়ে পরবর্তীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে এই মেয়ে বরজ সন্ন্যাসীনী বা যোগিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কথিত আছে, এই সন্ন্যাসীনী তার অনুসারীদের নিয়ে সপ্তাহে একদিন প্রায় সাত মাইল দূরে মুন্সীগঞ্জের ঘাটে এসে স্নান করতেন। এক সময় এই ঘাট পরিচিতি পায় যোগিনী ঘাট হিসেবে। বরজ নামটি কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে বজ্র হয় এবং সেই অনুসারে গ্রামটির নাম হয় বজ্রযোগিনী।

বজ্রযোগিনীতে যাওয়ার পথে দেখতে পাবেন প্রাচীন জমিদার বাড়ি, শান বাঁধানো ভগ্নপ্রায় পুকুরঘাট এবং কালের আঘাতে জীর্ণ বাড়ি-ঘর। এই গ্রামেরই সুশীতল বাতাসে একদিন শ্বাস নিতেন মহামতি অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। এখানকার পথে-ঘাটে ধুলো মেখে বড় হয়েছেন তিনি। বজ্রযোগিনী গ্রামের এক নিভৃত কোণে বসে করেছেন জ্ঞানের সাধনা। তার জ্ঞানের আলোয় তখন শুধু বজ্রযোগিনী আলোকিত হয়নি, সেই আলোর প্রভা ছুঁয়ে গিয়েছিল সুদূর তিব্বত।

বৌদ্ধ প-িত, ধর্মগুরু অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বজ্রযোগিনী গ্রামে ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে এক রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কল্যাণ শ্রী এবং মা প্রভাবতী দেবী। বাল্যকালে তার নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। বিজ্ঞানের পাঁচটি শাখায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন বিখ্যাত বৌদ্ধ গুরু জেতারির কাছ থেকে। অতি অল্প সময়েই তিনি হস্তশিল্প, ব্যাকরণ এবং গণিতশাস্ত্রে অসাধারণ পা-িত্যের স্বাক্ষর রাখেন। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত প-িত রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্মিক গুহ্যবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হোন। এরপর মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহা সাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করলে তাকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দীপঙ্কর ১০১১ খ্রিস্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণ দ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন এবং আচার্য চন্দ্রকীর্তির কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করেন, তখন তার বয়স ৪৩ বছর। মগধে ফিরে আসার পর তিনি তর্কযুদ্ধে মগধের প্রধান প-িতদের বাগি্নতা, যুক্তি ও পা-িত্য দিয়ে পরাজিত করেন। ১০৪০ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতের রাজা চ্যাং চুব (চ্যান-চাব) জ্ঞানপ্রভ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বত ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান।

অতীশ দীপঙ্কর কয়েকজন বিশিষ্ট প-িতসহ বিহারের পথে তিব্বত যাত্রা করেন। সেখানে পেঁৗছলে তিব্বতের রাজা চ্যং চুব এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেই রাজকীয় সংবর্ধনার চিত্রটি একটি প্রাচীন মঠের দেয়ালে আজও অাঁকা রয়েছে। এই রাজকীয় সংবর্ধনায় দীপঙ্করকে চা পানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানই প্রথম বাঙালি যিনি প্রথম চায়ের স্বাদ নেন। দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। এই সংস্কারের ফলে তিব্বতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধ ধর্মাচার প-িত প্রতিষ্ঠিত হয়। মহামতি বুদ্ধের পরেই তিব্বতবাসীরা তাকে শ্রেষ্ঠ গুরু হিসেবে সম্মান ও পূজা করেন এবং মহাপ্রভু হিসেবে মান্য করেন।

দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ ত্যঞ্জুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতি ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতিরা তাকে অতীশ উপাধিতে ভূষিত করে। অতীশ দীপঙ্কর অনেক সংস্কৃত এবং পালি বই তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেন। বিখ্যাত প-িত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতালির বিখ্যাত গবেষক টাকি দীপঙ্করের অনেকগুলো বই আবিষ্কার করেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নালন্দা এবং বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীশ দীপঙ্কর পাঠদান করেন। তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ৭৩ বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরের কাছে লেথান পল্লীতে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

অাঁকাবাঁকা বৃক্ষ শোভিত রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে পেঁৗছে যাবেন বজ্রযোগিনী গ্রামে। অতীশ দীপঙ্করের ভিটায়। স্থানীয় আধিবাসীদের ভাষায় প-িতের ভিটা কিংবা নাস্তিকের ভিটা। দূর থেকে চোখে পড়েছে চীনা স্থাপত্যরীতি অনুসারে তৈরি প্রাচীর, যা ঘিরে রেখেছে ভিটাকে। ভিটার ঠিক মাঝখানে চমৎকার চীনা স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত সৌধ। সৌধের ঠিক নিচে অতীশ দীপঙ্করের ১০২২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের ভিটায় ১০০০ তম জন্মবার্ষিকী পালন করা হয় ১৯৮২ সালে।

যেভাবে যাবেন
গুলিস্তান কিংবা সায়দাবাদ থেকে মুন্সীগঞ্জের মোক্তারপুর পর্যন্ত বাস রয়েছে বেশ কয়েকটি। মুক্তারপুর থেকে রিকশা, ভ্যান কিংবা অন্যান্য যানবাহন ব্যবহার করে বজ্রযোগিনী যাওয়া যায়। সদরঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জগামী বেশ কয়েকটি লঞ্চ মুন্সীগঞ্জ যায়। ঢাকা থেকে সময় লাগবে মাত্র দুই ঘণ্টা। বজ্রযোগিনী গ্রাম ছাড়াও দেখে আসতে পারেন মুন্সীগঞ্জ সদরে অবস্থিত ইদ্রাকপুর কেল্লা, রামপাল দীঘি, রামপালে বাবা আদম শহীদ (র.)-এর মাজার এবং বিখ্যাত সাত গম্বুজ মসজিদটি।

সংবাদ