সালাউদ্দিন যেভাবে জেএমবি ক্যাডার

salauddinগাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতে নেওয়ার পথে গুলি ও বোমা হামলা করে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গীদের একজন সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলাতে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জেএমবির এ শূরা সদস্য জঙ্গী হওয়ার পেছনেও রয়েছে নানা কাহিনী। স্কুল জীবনে মেধাবী এ সালেহীন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই গা ভাসায় জেএমবির সঙ্গে। পরিবারের দেওয়া নাম সালেহীন সোহেল হলেও জেএমবির সদস্য হওয়ার পর নাম হয়ে যায় সালাউদ্দিন।

সালাউদ্দিনসহ তার আরো দুইজন সহযোগীকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় রোববার সকালে। ওই সময়ে হামলায় পুলিশের একজন কনস্টেবল নিহত হয়েছেন।


ফ্ল্যাশব্যাক : মো. সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ও কামরুজ্জামান মতিন ওরফে আব্দুল মতিন জাকির। আপন দুই ভাই। বয়সের ব্যবধান মাত্র ৭ বছর। মেধাবী ছাত্র হয়েও তারা এখন ভয়ঙ্কর জঙ্গী নেতা। পরিবারের সদস্যরা বুঝে উঠতে পারেনি লেখাপড়ার আড়ালে কখন তারা জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বনে গেছেন জঙ্গী নেতা। পাড়া-প্রতিবেশীরা এ বিষয়টি চিন্তা করে রীতিমত আতকে উঠেন। এলাকাবাসী ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দুই ভাইয়ের পরিবারের দিক থেকে। তাদের মতে, শায়খ আব্দুর রহমান জামালপুর, বাংলা ভাই রাজশাহী আর সালাউদ্দিন ও তার ভাই মতিন বন্দর তথা নারায়ণগঞ্জবাসীর ললাটে নতুন করে এক কলঙ্ক এঁটে দিয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই দুই ভাই এখন দেশব্যাপী পরিচিত।

২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে জেএমবির আমীর শায়খ আবদুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন ও পৃষ্ঠপোষক কামরুজ্জামান মতিন ওরফে জাকির এবং ২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকা হতে সালাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক মোঃ ইসরাইল হোসেন এক হত্যা মামলায় সালাউদ্দিনকে মৃত্যুদ- সাজা প্রদান করেন। এছাড়া ময়মনসিংহ আদালতে বোমা হামলার ঘটনায়ও সালাউদ্দিনকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছিল।
salauddin
সালাউদ্দিন ও মতিনের বাবা রফিকুল ইসলাম শহরের জনতা ব্যাংক কালীর বাজার শাখায় টাইপিষ্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। তাদের গ্রামের বাড়ী মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ার থানা টেঙ্গারচর এলাকায়। ১৯৯৮ সালের বন্যার পর রফিকুল ইসলাম বন্দরের এইচ এম সেন রোডে বাড়ী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এর আগে বন্দরে ভাড়ায় থাকতেন। চার ছেলের মধ্যে তৃতীয় সালাউদ্দিন আর দ্বিতীয় মতিন। বড় ভাই শামসুজ্জামান শাহীন ঢাকার একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে কর্মরত।

এক নজরে সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন : মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিনের বয়স ৩৩। পরিবারের সদস্যরা তাকে ডাকতো সোহেল বলে। ১৯৯৭ সালে বাড়ীর পাশের বন্দর বিএম ইউনিয়ন স্কুল হতে মানবিক বিভাগ হতে কৃষি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ ৬৬৩ নম্বর নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। লেখাপড়াতে মেধাবী হওয়ায় সালেহীনকে ভর্তি করা হয় ঢাকার তেজগাঁওস্থ পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এর সিভিল বিভাগে।

২০০৬ সালের ২৬ এপ্রিল র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর সালাউদ্দিন জানায়, ১৯৯৯ সালে সানির সাথে পরিচয় হয় সালেহীনের। তখন সানি তাকে জেএমবি শায়খ আব্দুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। শায়খ রহমানের সংস্পর্শ পেয়ে ক্রমশ দুধর্ষ হয়ে উঠেন সালেহীন। পরবর্তীতে তার নাম পরিবর্তন করে সালেহীন থেকে সে হয় সালাউদ্দিন। শায়খের কাছ থেকে সে বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ নেয় এবং দক্ষ হয়ে উঠে।

অল্প দিনেই একজন ভালো সংগঠক হিসেবে সালাউদ্দিন পরিচিত পান। পরে শায়ক রহমান তাকে শূরা কমিটির সদস্য মনোনীত করেন। সে বাংলাভাইয়ের চেয়েও পুরনো জেএমবি সদস্য। শায়খ আব্দুর রহমানকে সিলেটের শাপলা বাগের বাসা সে ভাড়া করে দিয়েছিল। অনুরূপ বাংলাভাইকেও সে ময়মনসিংহে অবস্থান করার ব্যবস্থা করে দেয়। ২০০৬ সালের ১৭ মার্চ সালাহউদ্দিনকে গ্রেপ্তারের জন্য ১০ লাখ টাকার নগদ পুরস্কার ঘোষণা করেন সরকার। ২৪ এপ্রিল র‌্যাবের অভিযানে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী এলাকা হতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।


সে ২০০৫ সালের ১৭ আগষ্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ এবং ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি। ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক মোঃ ইসরাইল হোসেন এক হত্যা মামলায় সালাউদ্দিনকে মৃত্যুদ- সাজা প্রদান করেন। মামলার বিবরণে জানা যায়, জামালপুর জেলার শরিষাবাড়ী থানার হৃদয় রায় (ভিকটিম) খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। থানার শানারপোর গ্রামে ভিকটিম হৃদয় রায় গরীব মুসলমানদের অর্থের লোভ দেখিয়ে বায়োস্কোপের মাধ্যমে যিশুখ্রিষ্টের জীবনী দেখায় এবং খ্রিষ্টান ধর্মে উদ্বুদ্ধ করত। হৃদয় রায়ের এসব কর্মকা- শায়খ আব্দুর রহমানকে জানানো হলে তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন। রিপোর্টে জানানো হয় হৃদয় কাফের হয়ে গেছে। তাই তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে হামজো নামের এক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে সালাউদ্দিন এবং তার সহায়তায় হৃদয়ের ঘরে ঢুকে ছুরির আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সালাউদ্দিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

যেভাবে নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব পান সালাউদ্দিন : সূত্র মতে, ২০০২ সালের প্রথম দিকে ঢাকার মুগদাপাড়া ঝিলপাড়ের একটি বাসায় শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, বন্দরের সালাউদ্দিন, হাফেজ মাহমুদ, পিরোজপুরের খালেক, নাটোরের আবদুল আউয়াল ও খুলনার আসাদুজ্জামানের উপস্থিতিতে একটি বৈঠক হয়। সালাউদ্দিনের কাজে খুশী হয়ে শায়ক ও বাংলা ভাই তাকে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের দায়িত্ব দেন। ২০০২ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জস্থ ব্র্যাক অফিস লুঠের নেতৃত্ব দেন। যথাযথ দায়িত্ব পালন করার কারণে শায়খের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠেন সালাউদ্দিন। তাই রাজশাহীর বাগমারার অপারেশনে বাংলা ভাইকে সহযোগীতা করতে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এক নজরে কামরুজ্জামান মতিন ওরফে জাকির : সালাউদ্দিনের বড় ভাই কামরুজ্জামান মতিন ওরফে জাকির। বয়স ৩৫। ছোটকাল থেকেই ধর্মভীরু ছিলেন তিনি। মুন্সীগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর ভর্তি হয় যাত্রাবাড়ীতে মোহাম্মদীয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায়। ২০০০ সালে তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের দুই বছর পর ২০০২ সালে সৌদি আরবে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে তিনি স্বস্ত্রীক চলে যান সৌদি আরব। এর পর থেকে নিয়মিত তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতিন ও তার স্ত্রীর টেলিফোনে আলাপ হতো। তবে ছোট ভাই সালাউদ্দিন গ্রেপ্তারের পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। কিন্তু তখনও তার পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেনি সালাউদ্দিনের মত মতিনও জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। মতিন সৌদি আরবে কি কাজ করতেন তাও স্পষ্ট করে পরিবারের সদস্যদের জানায়নি। এক পর্যায়ে মতিন তার পরিবারের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তবে বন্দরের বাড়ি তৈরী করতে মতিন বেশ কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে বলে পরিবারের একটি সূত্র জানায়। ২০০৭ সালের আগষ্ট মাসে দেশে ফিরে আসার কিছুদিন পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন মতিন। এর পর থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ হয়নি বলে পরিবারের সদস্যদের দাবি।

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের মতিন জানায়, ১৯৯৮ সালে জেএমবির প্রথম বৈঠকে মওলানা মতিন উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঐ বৈঠকে প্রধান সন্বয়কারী হিসাবে কাজ করেন। সৌদি আরব থেকে মতিন জেএমবির জন্য অর্থ পাঠাতো বলে র‌্যাবের কাছে জানিয়েছে। সৌদি আরব থেকে মতিন জেএমবির আমীর শায়খ আব্দুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করত।

শীর্ষ নিউজ

Leave a Reply