করোনায়ও থেমে নেই দেশের প্রথম এলিভেটেড রেলের কাজঃ বসে গেছে ৫ স্প্যান

মো. মাসুদ খানঃ ঢাকা-মাওয়া-খুলনা এক্সপ্রেসওয়ের পাশ দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে দেশের প্রথম এলিভেটেড রেল লাইনের কাজ। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বাসাইল ইউনিয়নের পুলাশপুর প্রান্তে এ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে পাঁচটি স্প্যান। মার্চের প্রথম দিকে এখানে প্রথম স্প্যান বসলেও করোনাকালের মহা দুর্যোগে ও লকডাউনের মধ্যে বিগত তিনমাসে আর চারটি স্প্যান বসে গেছে পিলারের ওপরে। মোট পাঁচটি স্প্যান এখন দেখা যাচ্ছে পুলাশপুর প্রান্তে।

প্রচলিত রেলগাড়ির জন্য এটিই দেশের প্রথম এলিভেটেড রেল লাইন। ঢাকার জুরাইন স্টেশন থেকে শুরু করে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কুচিয়ামোড়া পর্যন্ত হবে এ রেললাইন। এর আওতায় দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মিত হচ্ছে এলিভেটেড রেলওয়ে স্টেশনও।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোভিড ১৯-এর কারণে কাজে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য এই কর্মযজ্ঞে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পে যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করেন, তাদের অধিকাংশই আশেপাশের এলাকার। এরমধ্যে মুন্সীগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জের শ্রমিকই বেশী। এইসব এলাকায় আছে করোনা মহামারীর ভয়, সে জন্য এই প্রকল্পে কাজ করা শ্রমিকদের বিগত কয়েকমাস যাবৎ বাড়িতে আসা যাওয়া বন্ধ করে কর্মস্থলেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে তারা প্রকল্প এলাকায় করোনার সংক্রমণ না করে। আপদকালীন করোনার মহাদুর্যোগেও কাজ স্থগিত রাখা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আরো জানান, একদিকে পিলার ওঠানোর কাজ চলছে, অন্যদিকে পিলারের ওপরে ইলেক্ট্রনিক মেশিনের সাহায্যে স্প্যান বসানোর কাজ চলছে সমান তালে। আস্তে আস্তে সিরাজদিখানের পলাশপুর থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে স্প্যান বসানোর কাজ।

গত মার্চ মাস থেকেই স্থানীয় শ্রমিকদের থাকা-খাওয়া দিয়ে ঝড় তুফানেও কাজ চলছে দেশের প্রথম এলিভেটেড রেললাইনের। এছাড়া কেরানীগঞ্জ এলাকার অনেক শ্রমিক কাজ করে এখানে। আর করোনার জন্য রেড জুন হলো কেরানীগঞ্জ, তাই ওই এলাকার শ্রমিকদের বাড়িতে আসা যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের দ্বারা কোন চাউনিজ বা বিদেশী প্রকৌশলী, স্টাফ ও শ্রমিক আক্রান্ত না হয়।

এলিভেটেড রেললাইন রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা করে পদ্মা সেতু দিয়ে যাবে যশোর পর্যন্ত। সেজন্য করা হচ্ছে ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন। দ্রুতগতিতে চলছে কাজ, বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু। এ সেতুর উপরের অংশ দিয়ে চলবে যানবাহন। নিচের অংশ দিয়ে চলবে ট্রেন। এ রেল লাইনের মধ্যে ২৩ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড রেলওয়ে।

রেললাইন করা হচ্ছে সিঙ্গেল। পরে সরকার চাইলে তা ডাবল করা হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড (সিআরইসি) এ কাজটি করছে। গত (৪ মার্চ) এ দুটি প্রকল্প এলাকার কাজ সরেজমিনে দেখার আয়োজন করে। ওই আয়োজনে অংশ নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলিভেটেড রেললাইনের প্রথম স্প্যান বসানো হচ্ছিলো মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার পলাশপুরে, যি এখনও অব্যাহত আছে।

এলিভেটেড রেললাইনের ২৩ কিলোমিটারে মোট ৪১৮টি স্প্যান বসানো হবে বলে জানান কর্তৃপক্ষ।

প্রকল্পের কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, এ এলাকা নিচু। এখানে অনেকগুলো ব্রিজ রয়েছে। ধলেশ্বরীর শাখা নদী ও অন্যান্য নদী রয়েছে। নদীগুলোর জন্য ব্রিজটা উঁচু করতে হচ্ছে। এটা যেহেতু রেললাইন, তাই হঠাৎ করে উপরে উঠে নিচে নামা যাবে না। একটা স্মুথ লাইন করতে হয় ট্রেনের জন্য। তাছাড়া এখানে যে পরিমাণ সফট সয়েল (নরম মাটি) আছে, তাতে বাঁধ দিয়ে করার চেয়ে এলিভেটেড করলে কম খরচ হবে। সেই সঙ্গে জমির পরিমাণও কমে যাবে। এখানে জায়গার দামও অনেক বেশি। সবদিক বিবেচনা করে এটা এলিভেটেড করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এলিভেটেড রেললাইন এটিই দেশে প্রথম। কেরানীগঞ্জে দেশে প্রথমবারের মতো এলিভেটেড রেলওয়ে স্টেশনও করা হচ্ছে। লাইনটা সিঙ্গেল হলেও ব্রডগেজে করা হচ্ছে।

এ রেল লাইন সাধারণত পরিকল্পনা করা হয় ৬০ থেকে ১০০ বছরের কথা চিন্তা করে। প্রতিনিয়ত ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ট্রেন যোগাযোগ বাড়বে। তাহলে একবারে ডাবল লাইন না করে সিঙ্গেল লাইন কেন করা হচ্ছে?

এমন প্রশ্নের জবাবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী ইতিমধ্যে বলেছেন, এক কথায় বলতে গেলে প্রচুর খরচের কারণে করছি না। আমরা ডাবল লাইনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে রাখছি। ভবিষ্যতে এটাকেই ডাবল লাইন করা যাবে। ঢাকা থেকে যশোরে কতগুলো ট্রেন চলবে, এ হিসাবে এখনই ডাবল লাইন করতে চাচ্ছি না। ডাবল লাইন আমরা হয়তো ১৫-২০ বছর পরে করতে পারি। যখন সরকার মনে করবে ডাবল লাইন করা দরকার, তখন এর পাশ দিয়ে আরেকটা করে ফেলবে। জায়গা থাকবে, শুধু ব্রিজ করলেই হয়ে যাবে।

সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশফিকুন নাহার বলেন, সরকারের এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যখনই আমাদের ডেকেছে তখনই তাৎক্ষণিক সেটা করে দিয়েছি। আমাদের দেশের জন্য এই প্রকল্প একটা মাইলফলক দৃষ্টান্ত। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে যেকোনোভাবে জড়িত থাকতে পেরে আমরাও গর্বিত। ভালোভাবে কাজটা স¤পূর্ণ হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

মুন্সীগঞ্জ ১ (শ্রীনগর-সিরাজদিখান) আসনের সংসদ সদস্য মাহি বি চৌধুরী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার ওপর দিয়ে সরকারের এই মেগা প্রকল্প হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার আমরা তাই করছি।

মুন্সীগঞ্জ-২ (লৌহজং-টঙ্গীবাড়ি) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক হুইপ অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, পদ্মা সেতুর জমি অধিগ্রহণে আমার এলাকার জনগণ অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। বাপ-দাদার ভিটেবাড়িসহ তাদের জমাজমি ছেড়ে দিয়েছে। এখন আবার রেললাইন হচ্ছে। এ প্রকল্পের জন্যও আমার এলাকার লোকজন জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনায় মুগ্ধ হয়ে তারা এ প্রকল্পের জন্য আরো জমি ছেড়ে দেন কোন প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়াই। সরকারের এ সকল কাজে আমার এলাকার জনগণ যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তার জন্য তাদের অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এরকম ভাল কাজে আমাদের পক্ষ থেকে অবশ্যই সহযোগিতা ছিল এবং থাকবে। আর এ রেল লাইন হয়ে গেলে আমার এলাকার জনগণও এর সুফল পাবে।

কালের কন্ঠ

Leave a Reply