বিশেষ একটি কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের জটিলতার শিকার পদ্মা সেতু

রতন বালো
বিশ্বব্যাংকের প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে অর্থায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক চায়না রেলওয়ের কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিআরসিসি) নামে একটি বিশেষ কোম্পানিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার জন্য বার বার চাপ দিচ্ছে বলে এই জটিলতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ পিছিয়ে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে গতকাল যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সম্মতির বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর কথা বলা প্রয়োজন। এতে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন কার্যক্রম বিলম্ব দূর হবে এবং নির্মাণ কাজ শুরু ত্বরান্বিত হবে বলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানান।

গত ২৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পদ্মা নদীবক্ষে ‘ভাষা শহীদ বরকত’ জাহাজে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূইয়া এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর অ্যালেন গোল্ডস্টেইন ১২শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তিপত্রে সই করেন। চুক্তি সই খবরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষ আনন্দে উদ্বেলিত হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণে বিলম্ব হওয়া নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

২৯০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিতব্য মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ১৫শ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে। পর্যায়ক্রমে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭৬ মিলিয়ন, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ১৪০ মিলিয়ন ও জাপান ৪০০ মিলিয়ন ডলার চুক্তি সই করে।

যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান মহাজোট সরকার গঠনের ১৩ দিনের মাথায় ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় এবং ২৯ জানুয়ারি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরামর্শক কমিটি ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হতে বিস্তারিত ডিজাইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ভূমি অধিগ্রহণ, এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং র‌্যাপ-১ এর আওতায় ৪টি পুনর্বাসন এলাকার মাটি ভরাট কাজও সম্পন্ন করা হয়েছে বলে যোগাযোগমন্ত্রী দাবি করেন। ইতোমধ্যে প্রধান সেতু, এ্যাপরোচ রোড এবং রিভার টারনিং ওয়ার্ক এর বিস্তারিত ডিজাইনও চূড়ান্ত করা হয়েছে।

ঋণদানের বিষয়ে চলতি বছর ১৮ মে জাপানের সঙ্গে প্রতিশ্রুত ঋণচুক্তির স্বাক্ষর হয়েছে। এর আগে ধারণা করা হয়েছিল জাপানে সুনামির ফলে ঋণ পাওয়া যাবে না, পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে না। এমন অভিযোগ অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। ঋণ প্রদানের অনিশ্চয়তার আশঙ্কা দূর হয়েছে। এ ছাড়া ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে গত ২৪ মে এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে গত ৬ জুন প্রতিশ্রুত ঋণচুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।

গত বছর ১১ এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদিত প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে ১১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এর মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্য বিবেচিত হয়। মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে প্রাক-যোগ্য ৫টি প্রতিষ্ঠান-এর অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের নিকট পাঠানো হয়। বিশ্ব ব্যাংকের গাইড লাইন মেনে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও বিশ্বব্যাংক গত বছর ১০ অক্টোবর পর্যন্ত কমিটির সুপারিশের ওপর সম্মতি না দিয়ে প্রায় পূর্বে উল্লেখিত বিশেষ কোম্পানিটিকে প্রাক-যোগ্যতা বিবেচনা করার জন্য ৩ মাস পর পুনঃটেন্ডার আহ্বানের জন্য পরামর্শ দেয়। ১১ অক্টোবর পুনরায় (দ্বিতীয়বার) প্রাক-যোগ্যতার দরপত্র আহ্বান করলে ১০টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে এবং বিদেশি উপদেষ্টা ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির মূল্যায়নের প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আগের প্রাক যোগ্যতার দরপত্রে প্রাক-যোগ্য বিবেচিত হয় আগের ৫টি প্রতিষ্ঠান।

সূত্র জানায়, দ্বিতীয়বার আহ্বানকৃত প্রাক-যোগ্যতা মূল্যায়ত প্রতিবেদন গত ৭ জানুয়ারি বিশ্বব্যাংকের সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হলে ২৯ মার্চ বিশ্বব্যাংক দ্বিতীয়বারের মতো চায় না রেলওয়ের কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করে। এবং বিদেশি উপদেষ্টা ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির(সিআরসিসি) দাখিলকৃত কাগজপত্র পুনঃপরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানির’কে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় না বলে প্রতিবেদন দাখিল করে এবং বিবিএ গত ৩০ মার্চ প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকের বরাবরে প্রেরণ করে। গত ৬ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক সিআরসিসি’কে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় কি না_মন্তব্যসহ এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য তৃতীয়বারের বিবিএ’কে অনুরোধ করে বিশ্বব্যাংক। বিবিএ বিদেশি উপদেষ্টার প্রতিবেদন সংযুক্ত করে সিআরসিসি’কে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা না করার কারণ ব্যাখ্যা করে বিশ্বব্যাংকে পত্র দেয়।
গত ১৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক সিআরসিসি-এর নিকট থেকে সেতু নির্মাণের পাইলের বিষয়ে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিআরসিসি’কে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা যায় কিনা মর্মে বিবিএকে চতুর্থবারের মতো নির্দেশনা প্রদান করে। সিআরসিসি-এর নিকট রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার ডকুমেন্ট চাওয়া হলে তারা ছবিসহ কিছু ডকুমেন্ট দাখিল করে। বিদেশি উপদেষ্টা ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) রেকিং পাইলের অভিজ্ঞতার ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় দেখতে পায়, অন্য প্রতিষ্ঠানের করা ব্রিজের ছবি পরিবর্তন করে সিআরসি-এর নামে জমা দিয়েছে। গত ৭ মে বিদেশি উপদেষ্টা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে সিআরসিসি অসত্য তথ্য দাখিল করেছে।

জানা গেছে, গত ৯ মে সিআরসিসি বিবিএ’কে পত্র দিলে মূল সেতু প্রাক যোগ্যতার প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়। এবং তাদের স্থানীয় এজেন্ট ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লি.-এর এজেন্সিশিপ বাতিল করা হয়। এতে প্রমাণিত হয় সিআরসিসি এর পক্ষে স্থানীয় প্রতিনিধি ভেঞ্চার ইন্টারন্যাশনাল লি.বিভিন্ন জাল তথ্য পরিবেশন করেছে। গত ১১ মে বিবিএ বিদেশি উপদেষ্টার প্রতিবেদন ও সিআরসিসি-এর প্রাক-যোগ্যতা প্রত্যাহার প্রস্তাব বিশ্বব্যাংক বরাবরে দাখিল করে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতার ওপর সম্মতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হয়। পরে ১২ মে বিশ্বব্যাংক আপডেট প্রাক যোগ্যতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বিবিএ’কে অনুরোধ করে। সে অনুযায়ী যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে প্রি কোয়ালিফাইড ৫টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকে আপডেট প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, পদ্মা সেতু আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে সেতু বিভাগ একশ’ ভাগ স্বচ্ছতা, দক্ষতা, দ্রুততা, সরকারি নিয়ম-কানুন ও বিশ্বব্যাংকের প্রকিউরমেন্ট গাইড লাইন অনুসরণ করা হয়েছে। এতে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।

Leave a Reply