আতঙ্ক, অত:পর ……….

আলমগীর মাহমুদ
মিসেস রুশনারা ঘুম থেকে একটু দেরী করেই উঠেন। সদ্য বিবাহিতা, স্বামী চাকুরে। স্বামী সকালেই চলে যায় কাজে, রুশনারা সারা দিন একা একা দিন কাটায়। টিভি দেখেই বেশীর ভাগ সময় পার করে। মাঝে মাঝে স্বামীর ফোন আসে, ফোনে আলাপ জমে। যখন ফোনটা রেখে দেয় তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। একাকিত্ব যেন আর কাঁটতে চায়না। সপ্তাহের দুটো দিন কাছে পায় স্বামীকে। সে দিনও বাজার-সদাই করতে করতে কিংবা অন্যান্য কাজ করতে দিন কেটে যায়। সরকার যদি সপ্তাহে তিনদিন বন্ধ দিতো তাহলে ভালই হতো, ইচ্ছেমতো ঘুরতে পারতো রুশনারা স্বামীকে নিয়ে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠে, মোবাইলটা দ্রুত হাতে উঠিয়ে নেয় রুশনারা। কানে দিতেই ওপাশ থেকে ‘ঐ মিয়া তুমারে না কইলাম সক্কাল সক্কাল আইয়া পড়তে, আর তুমি অহনও বাড়িতে’ যাও মিয়া তুমার চাকরী নট”। রুশনারার কাছ থেকে কোন কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে ওপাশ থেকে আরো জোড়ে বলে ওঠে ‘ওই বেটা কথ কছনা কে ?’। রুশনারা আস্তে করে বলে আপনি বোধহয় রং নাম্বারে ফোন করেছেন, বলেই ফোনটি কেটে দেয় এবং জোড়ে হেসে উঠে।

অজান্তেই জানালার কাছে চলে আসে, চোখ পড়ে বাড়ীর খোলা উঠোনে বড় খেজুর গাছের নীচে। একজন অজ্ঞাত লোক একটি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ব্যাগটি এমন ভাবে ধরে আছে, যাতে পড়ে না যায়। খুব শক্ত হাতে ধরে আছে ব্যাগটি, ব্যাগটি একটু অদ্ভুত ধরণের। লোকটির চাহনি যেন কেমন, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে বারবার। লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন কিছু চুরি করে পালিয়েছে, কেউ হয়তো ধরে ফেলবে। লোকটি একটু সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং পরক্ষণেই পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। কিছুক্ষণ পর রাস্তার দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু আবার পুনরায় ফিরে আসে। এভাবেই কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার পর লোকটি তার হাতের ব্যাগটি গাছের পাশে রাখে। রুশনারা লোকটিকে দেখে একটু অবাক হয়। এই ভর-দুপুরে লোকটি খেজুর গাছের নিচে কি করে? রুশনারার মনে একটু সন্দেহ জেগে উঠে। অজ্ঞাত লোকটির চলা-ফেরা রুশনারার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। রুশনারা কি করবে, কিছু ভেবে পায়না। আশে-পাশে কেউ নেই যে কাউকে ডাকবে। এবার লোকটি রুশনারার ঘরের দিকে এগিয়ে আসে, পাশের বাড়ীর ছাদের দিকে তাকায়, পাশের বাড়ীর জানালার কাছে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পুনরায় গাছের নিচে ফিরে যায়। লোকটিকে এবার একটু বিরক্ত হতে দেখা যায়, কিন্তু তার চাহনিকে রুশনারার কাছে কেমন সন্দেহের ভিত তৈরী করে।

পাশের রাস্তায় একটি কাল রংয়ের বোরকা পরা মেয়েকে আসতে দেখা যায়। মেয়েটি আসতে আসতে রাস্তার পাশে একটি গাছের আড়ালে দাঁড়ায়। রুশনারা ছেলেটিকে ভাল করে লক্ষ করে। মেয়েটি গাছের নিচ থেকে ছেলের দিকে তাকায়, ছেলেটিও মেয়েটার দিকে তাকায়। তাদের চোখা-চোখি হয়। ছেলেটি মাথা নাড়ে, আবার মেয়েটিও মাথা নাড়ে। তারা ইশারায় কি যেন বলে। রুশনারা কিছু বোঝেনা। কিন্তু তার মনে এবার সন্দেহের তীরটি আরো তীব্র ভাবে গেঁথে যায়। সে কি করবে ভেবে পায়না। স্বামীকে ফোন করবে কিনা এক মুহুর্ত ভেবে নেয় সেটা। কিন্তু সে ফোন করেনা। পুনরায় জানালা দিয়ে তাকায়। হাঠাৎ তাকিয়েই দেখে মেয়েটির হাতেও অনরূপ আরেকটি ব্যাগ। কোথা থেকে এল ব্যাগটি। মেয়েটি যখন আসে তখনতো ব্যাগটি তার হাতে ছিলনা। মেয়েটি কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকায়, চোখ দিয়ে ইশারা করতেই ছেলেটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে মেয়েটার কাছে ধীরে ধীরে চলে যায়। কাছে গিয়ে ছেলেটা মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে একটু বিচলিত হতে দেখা যায়। মেয়েটা দ্রুত তার হাতের ব্যাগটি ছেলেটার হাত দিয়ে চলে যায় পাশের বাড়িতে। ছেলেটি ব্যাগ দুটি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে পাশের সরকারী হাসপাতালে দেয়াল টপকে ব্যাগ দুটি রেখে আবার ফিরে আসে এবং দ্রুত পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ে যেখানে মেয়েটি ঢুকেছে।

রুশনারা কোন কিছু বুঝে উঠতে পারেনা। হাতের মোবাইলটা তুলে নেয়, কিছু একটা চিন্তা করে সে ফোন করে থানায়। থানা থেকে মুহুর্তের মধ্যেই পুলিশ চলে আসে। একজন নয় বেশ কয়েকজন পুলিশ। ১০-১২ জন হবে হয়তো। সবার মাথায় হেলমেট। পুলিশ দেখে আশে-পাশের বাড়ি লোকজন বেরিয়ে আসে, সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। হঠাৎ এত পুলিশ কেন। সবাই সবার সাথে একটু-আধটু আলাপ করে। পরিস্থিতি কেমন ঘোলা মনে হয় তাদের কাছে। একজন অফিসার মত পুলিশ সবাইকে রেডি হতে বলতেই পুলিশ পাশের বাড়িটির চারদিকে অবস্থান নেয় এবং বাড়ির দিকে বন্দুক তাক করে থাকে। আশে-পাশের লোকজনকে দ্রুত সরে যেতে বলে। লোকজন দ্রুত সেখান থেকে সরে যায়। কয়েকটি বাড়ির জানালা ফাঁক করে মহিলারা, ছোট বাচ্চারা উঁকি দেয়। পুলিশ বন্দুক তাক করে আছে বাড়ির দিকে। যেন অর্ডার পেলেই গুলি চালাবে। রুশনারা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে, কি হচ্ছে। অফিসার পুলিশটি এবার বাড়ির দিকে চিৎকার করে বলতে থাকে, বাড়ির ভেতের যারা আছেন তারা দ্রুত বেরিয়ে আসুন, নাহলে আমরা গুলি করবো। কিন্তু কেউ বেরিয়ে আসেনা। এবার আরো জোড়ে জোড়ে বলতে ‘বাড়ির ভেতরে যারা আছে, তারা বেরিয়ে আসুন’ আমরা আপনাদের কিছু বলবোনা, আপনারা বেরিয়ে আসুন, আপনাদের কোন ভয় নেই, আপনারা বেরিয়ে আসুন’। কিন্তু ভেতর থেকে কোনা সাড়া-শব্দ পাওয়া যায়না। অফিসারটি তার হাতে থাকা ওয়াকিটকিতে কি যেন বলে। অন্যান্য পুলিশরা যে যার মত পজিশন নিয়ে এ্যাকশন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

ভেতর থেকে কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে তার কোমরে থেকে পিস্তলটি বের করে এগিয়ে যায় ভেতরের দিকে। পুলিশগুলো একটু নড়ে-চড়ে উঠে। চারদিকে নিস্তব্ধতা। আশে-পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে অনেক উৎসুক চোখ। কিছুটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। রুশনারাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জানালা দিয়ে। তার চোখের দৃষ্টি গিয়ে ঠেকেছে ঐ বাড়িটির ভেতরে। পুলিশের অফিসারটি এবার বেরিয়ে আসে, কিন্তু একা নয় তিনজনকে নিয়ে। ঐ মেয়ে আর ছেলেটি এবং অন্য একটি মেয়ে। পুলিশ অফিসারটি ওদেরকে ধরে নিয়ে বাইরে আসতেই অন্য পুলিশগুলো ওদেরকে ঘিরে ফেলে। এবার পুলিশ অফিসারটি জিজ্ঞেস করে
– বল ব্যাগ কোথায় রেখেছিস আর ব্যাগের মধ্যে কি আছে
ছেলেটি নিরুত্তর
– বল ব্যাগ কোথায় রেখেছিস
– ঐ দেয়ালের পাশে, ছেলেটি মাথা নিচু করে উত্তর দেয়।

এবার অফিসারটি দেয়ালের কাছে ছেলেটিকে নিয়ে যায়, অন্য পুলিশরা মেয়ে দুটিকে ঘিরে রাখে।

ছেলেটি দেয়ালের ওপাশ থেকে ব্যাগ দুটি নিয়ে আসে। খেজুর গাছের নিচে রাখে, সকল পুলিশ একটু বেশী শতর্ক হয়ে উঠে। এবার অফিসার ছেলেটিকে জোড়ে ধমক দিয়ে বলে

– খোল, ব্যাগ খোল, দেখা ব্যাগের মধ্যে কি আছে

ছেলেটি একটি ব্যাগ উপর করে ভেতরের জিনিষ ফেলতে চাইলে অফিসারটি আবার ধমক দেয়।

– ঐ বেটা, আস্তে আস্তে ব্যাগ খোল। সবাই সাবধান, সবাই সবধান, সবাই নিরাপদ দুরুত্তে থাকো।

অফিসারের ধমক খেয়ে ছেলেটি ভেতর থেকে একটি কাগজ বের করে এবং বলে যে ‘এর ভেতরে শুধু কাগজ, কাগজ ছাড়া আর কিছুই নেই’

– কাগজ, কিসের কাগজ, আর এত কাগজ কেন, অফিসারের প্রশ্ন
– স্যার এ শুধু কাগজ না, এগুলো সব প্রেম পত্র, ছেলেটির নির্দ্ধিদায় উত্তর দেয়
– প্রেম পত্র
– হ্যা স্যার, প্রেম পত্র

প্রেম পত্র বলার সাথে সাথে সকল পুলিশ একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে। আশে-পাশের বাড়ির জানালাগুলো খুলে যায়।

– এগুলো কি সত্যি সত্যিই প্রেম পত্র, অফিসারের জিজ্ঞাসা
– জ্বি স্যার, এগুলো সবই প্রেম পত্র, এইটা আমার ব্যাগ, এখানে ওর লেখা প্রেম পত্র আর ওইটা ওর ব্যাগ, ওখানে আমার লেখা প্রেম পত্র। এ কথা বলে ছেলেটি দুটি ব্যাগ উপুর করে ধরা মাত্র দুটি ব্যাগ থেকে অসংখ্যা কাগজ বের হয়ে আসে। সাথে সাথে পুলিশের দল বন্দুকের নল গুটিয়ে উৎসুক হয়ে কাগজ গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অফিসার একটা কাগজ উঠায় এবং জোড়ে জোড়ে পড়তে থাকে “আমি তোমাকে ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি’ আর হাসতে থাকে।

রুশনারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আশে-পাশের কিছু লোকও এসে জড়ো হয় সেখানে। অফিসার এবার সবগুলো কাগজ নেড়ে-চেড়ে দেখতে থাকে। ক্রমেই মানুষের ভিড় বারতে থাকে। ছেলে আর মেয়েটি মাথা নিচু করে থাকে।

– আচ্ছা ভাল কথা, এগুলো প্রেম পত্র, তাহলে এগুলো ঐ দেয়ালের ওখানে ফেলে রেখেছো কেন, আর তোমরা ঐ বাড়িতে কি করছিলে, অফিসার এবার আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নটি করে
– স্যার, আমি এই মেয়েটিকে ভালবাসি, কিন্তু কিছুদিন যাবত আমাদের মধ্যে মন-মালিন্য চলছে। কেউ কারো সাথে দেখা করিনা, ও আমাকে কেমন যেন আগের মত ভালবাসে না। এ চিঠিগুলো আমাদের দীর্ঘ দিনের স্বাক্ষী। আমরা দুজনে বেশী করে চিঠি লিখতাম। কিন্তু হঠাৎ কি হলো ও আমাকে আমার ভালবাসেনা। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের কাছে থাকা সব চিঠি আমরা ডোবায় ফেলে দেবো। তাই চিঠিগুলো ডোবায় ফেলেছি, ছেলেটি উত্তর দেয়
– তাহলে ওই বাড়িতে কি করছিলে, পুনরায় প্রশ্ন করে অফিসার
– ওই বাড়িতে ওর বান্ধবি থাকে। ওর বান্ধবির মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক হয়েছিলো আজ ওর সামনেই আমাদের বিচ্ছেদ হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা দুজনেই পারস্পরিক সিদ্ধান্তে প্রেক্ষিতে আজ থেকে ভালবাসা শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

অফিসারটি এবার মেয়ে আর ছেলেটাকে ভাল করে দেখে। ছেলেটার চোখে জল। মুখটা কেমন বিষন্ন। মেয়েটার মুখ বোরকায় ঢাকা বলে কিছু বোঝা যাচ্ছেনা।

– তোমাগো নাম গিনিজ বুকে উঠবো। আমার জীবনে এত প্রেম পত্র দেহি নাই। খুবই রোমান্টিক ভাষা। শোন আমার উচিৎ ছিল তোমাদের থানায় নিয়ে বেদম প্রহার করা, কারণ তোমরা যান চারিদিকে এখন বোমাতঙ্ক, আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি, সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে। যে কোন ব্যাগই আমাদের জন্য সন্দেহজনক। যেহেতু বিষয়টি প্রেমের, তাই তোমাদের আমি কিছুই বলবোনা, তবে তোমাদের একটি শাস্তি পেতেই হবে, অফিসার কথাগুলো গুছিয়ে বলে
– কি শাস্তি স্যার, এবার মেয়েটি মুখ খোলে
– কি শাস্তি, এ এক কঠিন শাস্তি, তোমরা কেউ কাউকে কখনেই ভুলতে পারবেনা। ভালবাসা শেষ নয়, আজ থেকে নতুন করে তোমাদের ভালবাসা শুরু হবে। চলো আমার সাথে……………।

আলমগীর মাহমুদ
বাগমামুদালি পাড়া
মুন্সীগঞ্জ-১৫০০
ই-মেইল: amahmud04@yahoo.com

Leave a Reply