গজারিয়ায় ৯ বছরে গুলিতে নিহত ৮, আহত অর্ধশত
আমিরুল ইসলাম নয়ন: আধিপত্য বিস্তার এবং ক্ষমতা প্রদর্শনের রাজনীতিতে আশঙ্কাজনকভাবে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায়। গত ৯ বছরে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ৮ জন নিহত ও প্রায় অর্ধশত আহত হওয়ার পরও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা না থাকায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গজারিয়া উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বহুবার গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

এসব ঘটনায় এক ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, ছাত্রলীগ নেতাসহ ৮ জন নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয় অন্তত অর্ধশত মানুষ। বিভিন্ন সময় অস্ত্রবাজদের ছবি এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলেও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশের তেমন তৎপরতা লক্ষ করা যায়নি। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়া এবং বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে সাধারণ মানুষের।

বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মর্জিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী শামসুদ্দিন প্রধান বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দিন তাকে নৃশংসভাবে গুলি করে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার চাই আমি।

আরেক ভুক্তভোগী কামাল সরকার বলেন, আধিপত্য বিস্তারে রাজনীতিতে ২০১৬ সালে আমার ভাই গোলাপ সরকারসহ পাঁচজনকে একই দিনে গুলি করে হত্যা করে নাজমুল বাহিনীর লোকজন। ওইদিন এই ঘটনায় অন্তত অর্ধ শতাধিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ঘটনায় এজাহার নামীয় আসামিরা আটক হলেও অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।

বিষয়টি সম্পর্কে গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক চৌধুরী খোকন বলেন, গুয়াগাছিয়াতে কারা চিহ্নিত অস্ত্রবাজ সবাই তাদের চিনে। গত দুটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমার সমর্থকরা একাধিকবার গুলিবদ্ধ হয়েছে। পুলিশ একটি অস্ত্রও উদ্ধার করতে পারেনি। খবর নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বালুয়াকান্দি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুদ্দিন প্রধান এবং স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল মান্নানের স্ত্রী লাকি আক্তার নিহত হয়।

২০১৬ সালের ২৪ মে গজারিয়ার হোসেন্দীতে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হানিফ (২৫) নামের একজন মারা যায়। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই গজারিয়ার হোসেন্দী ইউনিয়নের চরবলাকি গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইউপি সদস্য গোলাপ সরকারসহ নিহত হয় পাঁচজন। এ ঘটনায় আরও অন্তত ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়।

২০১৬ সালের ২২ আগস্ট উপজেলার ইমামপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শেখ ফরিদ গ্রুপ ও রাসেল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুজন গুলিবিদ্ধ হয়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এ সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১১ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় পিস্তল ও ৯ রাউন্ড গুলিসহ রাসেল নামের একজনকে আটক করে পুলিশ। ২০১৯ সালের ২ নভেম্বর ইমামপুর ইউনিয়নের ষোলআনীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়।

২০২১ সালের ৫ নভেম্বর ইমামপুর ইউনিয়নে নির্বাচন পূর্ববর্তী সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় অন্তত ৩০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ হয়। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি উপজেলার ইমামপুর ইউনিয়নের স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মনসুর আহমেদ খান জিন্নাহর বাড়ি লক্ষ্য করে ৮ রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল বাউশিয়া পুরান ফেরিঘাট সংলগ্ন গোমতী নদীতে ট্রলারের ইঞ্জিন মেরামতের সময় ডাকাত দলের হামলায় তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়।

২০২২ সালে ২ নভেম্বর মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল হক মিঠুর সমর্থকদের হামলায় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহবুব মিয়ার ৩ সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়। ২০২২ সালের ২১ নভেম্বর গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় চারজন গুলিবিদ্ধ হয়। ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল, হোসেন্দী গ্রামে মুহুর্মুহু গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এলাকাবাসী।

২০২৩ সালের ২১ মে হোসেন্দীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের দুই দফা হামলায় নারীসহ চারজন আহত হয়েছে। এ সময় আতঙ্ক তৈরি করতে পাঁচ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয় বলে জানিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে গত ১৩ অক্টোবর, ইমামপুর ইউনিয়নের হোগলাকান্দি গ্রামে গ্রাম্য সালিশে তিন রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে।

বিষয়টি সম্পর্কে মুন্সীগঞ্জ সদর-গজারিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান বলেন, অস্ত্র হাতে সম্প্রতি নয়ন বাহিনীর সদস্য পিয়াস এবং আতাউর নামে একজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তাকে আটকে অসংখ্যবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পুলিশের তৎপরতায় অবৈধ অস্ত্রবাজদের দৌরাত্ম্য কমেছে।

সময়ের আলো