শাপলা বিক্রিতে চলছে কর্মহীন কৃষকের সংসার

মুন্সিগঞ্জের প্রান্তিক পর্যায়ে শাপলা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে কর্মহীন হয়ে পড়া শতাধিক কৃষক। বর্ষা মৌসুমে শাপলা বিক্রি করে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবারের সংসারের খরচ মিটছে। বিনা পুঁজিতে দৈনিক ৯শ থেকে ১৩শ টাকাআয় করছেন একেকজন কৃষক।

বর্ষার পানিতে টইটুম্বর মুন্সিগঞ্জের জেলার শ্রীনগর, সিরাজদিখানের খাল-বিল ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি। সেখান থেকে শাপলা তুলে তা বাজারে বিক্রি করছেন এ অঞ্চলের কৃষক। চার মাস শাপলা বিক্রি করেই দেড় শতাধিক পরিবারের রোজগার হয় এবং বছরে বেশ কয়েক মাস সেই অর্থ দিয়ে তাদের সংসার চলে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার বর্ষার পানিতে ডুবে থাকা প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে প্রাকৃতিকভাবে শাপলা উৎপন্ন হয়েছে।

জৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত ৪ মাসব্যাপী চলে শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রির কার্যক্রম। অধিদফতরের এক গবেষণা অনুযায়ী বলা হচ্ছে, যথাযথ সংরক্ষণ ও বিদেশে রফতানি করা গেলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

শনিবার (১৯ আগস্ট) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, শ্রীনগরের আড়িয়াল বিলে বর্ষায় জমেছে পানি। এতে স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে শাপলা। আর এসব শাপলা ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকাতে করে বিক্রির উদ্দেশ্যে আঁটি বাঁধছেন কৃষকেরা। অন্তত অর্ধশতাধিক কৃষক সারিবদ্ধভাবে তুলছেন শাপলা। পরে একাধিক ভাসমান হাটে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে।

প্রান্তিক কৃষকরা জানান, সারাবছর আড়িয়াল বিলে ফসলি জমিতে নানা প্রকার ফসল উৎপাদন করলেও বর্ষা মৌসুমে কৃষি জমি পানির নিচে থাকায় এ মৌসুমে কৃষকের তেমন কোনো কাজ থাকে না। স্থানীয় নানা বয়সী অনেক কৃষক এ পেশায় জড়িয়েছেন নিজেকে। শাপলা সংগ্রহে কোন পুঁজির প্রয়োজন না হওয়ায় এ পেশায় অংশ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকেই। এতে প্রতিদিন গড়ে এক একজন কৃষকের আয় হচ্ছে এক থেকে দেড় হাজার টাকার বেশি অর্থ।

১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর আয়তনের এ বিলে শুষ্ক মৌসুমে আলু-ধানসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদন হলেও বর্ষাকালের শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে বিলের পানিতে দিগন্ত জুড়ে ফুটে উঠে শাপলার সমারোহ।

আড়িয়াল বিলের আলমপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিলের পাশে স্তুপ করা রাখা হয়েছে শাপলা। আরেকটু এগিয়ে দেখা যায় নৌকা থেকে ঢাকায় পাইকারিভাবে বিক্রির উদ্দেশ্যে শাপলা তোলা হচ্ছে পিকআপভ্যানে। শুধু আলমপুর নয়, এমন চিত্র দেখা গেছে বিলের দয়হাটা, শ্যামসিদ্ধি, গাদিঘাট, শ্রীধরপুর, বাড়ৈখালী, মদনখালী, আলমপুর, কেউটখালী, মোহনগঞ্জ, কামারগাঁও, জগন্নাথপট্টি, কাঁঠালবাড়ি, মহতপাড়া এলাকায়। এসব এলাকায় এখন জমজমাট ভাসমান শাপলা বিক্রির হাট।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, বর্ষায় ডুবে যাওয়া আড়িয়ল বিলের ইরি, পাট ও আমন ধানের জমিতে এখন শাপলা আর শাপলা। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই শাপলার সমারোহ। ইছামতি নদীর সংলগ্ন বিভিন্ন খালের ও বিলের পানিতেও ফুটেছে শাপলা।

সাধারণত আষাঢ় মাস থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত পাওয়া যায় শাপলা। এ সময় এলাকার শাপলা সংগ্রহকারী কৃষকরা ভোরবেলায় নৌকা নিয়ে ডুবে যাওয়া জমি ও বিলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে শাপলা সংগ্রহ শুরু করেন এবং শেষ করেন দুপুরের দিকে। তবে মৌসুমের শেষ অর্থাৎ কার্তিক মাসের সময় শাপলা তেমন বেশি পাওয়া যায় না।

আড়িয়াল বিল থেকে শাপলা সংগ্রহ করেন মোহাম্মদ হোসেন নাসের জানান, একজন কৃষক প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ মোঠা (৭০ থেকে ৮০ পিস শাপলায় ১ মোঠা) শাপলা সংগ্রহ করতে পারে।

তিনি জানান, একটা সময় ছিল যখন অভাবী লোকজন শাপলা তুলে এনে সবজি হিসেবে প্রতিদিন ভাতের সঙ্গে খেয়ে জীবন বাঁচাতেন। আর এখন শাপলা একটি মজাদার খাবারে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কাওরান বাজার থেকে পাইকারি শাপলা কিনতে আড়িয়াল বিলে এসে আফসার উদ্দিন বেপারী, টিপু মিয়া, আব্দুল বারেক, কাদের মুন্সিসহ আরও বেশ কয়েকজন ক্রেতা বলেন, সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মোঠা শাপলা এক-একজন পাইকার ক্রয় করে থাকেন। সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে এক মোঠা শাপলা ১৩ থেকে ১৬ টাকা দরে ক্রয় করেন। তারপর গাড়ি ভাড়াসহ গড়ে ৩ টাকা, লেবার খরচ ১ টাকা, আড়ৎদাড়ি খরচ ২ টাকাসহ মোট ২০ থেকে ২২ টাকা খরচ পড়ে।

পরে কাওরানবাজার ও যাত্রাবাড়ীর পাইকারি সবজির আড়তে এসব শাপলা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে প্রতি মোঠা। ৭০ থেকে ৮০টি শাপলার এক মোঠা খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।

তারা আরও বলেন, গত কয়েক বছর যাবৎ এই ব্যবসাটি এলাকায় বেশ প্রসার লাভ করেছে। এতে করে বেকার কৃষকদের কর্মসংস্থানের একটি সুযোগ হয়েছে বর্ষা মৌসুমে। এছাড়াও শাপলা বিক্রি করে কয়েক শতাধিক কৃষক পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে আছে।

এদিকে কান্ত দাস, নির্মল গুণ, শরীফ আলী, পচু মিয়া, লালন কাজীসহ এলাকার আরও কৃষকরা জানান, তারা দিন রাত পরিশ্রম করে যেটুকু শাপলা সংগ্রহ করতে পারে তা দিয়ে চেলে যায় তাদের সংসার এসব শাপলা বিক্রয় করে তারা খুব সুখে এবং শান্তিতে আছেন।

কৃষকদের দাবি, শাপলা সংগ্রহের বিষয়ে যদি কোনো কৃষি পরামর্শ দেওয়া হতো, তাহলে তারা সংসার চালানোর পাশাপাশি হয়তো এর থেকে কিছুটা বাড়তি আয়ের উৎস ও খুঁজে পেত।

তবে জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা.মো. আব্দুল আজিজ বলেন, যথাযথ সংরক্ষণ ও বিদেশে রফতানি করা গেলে শাপলা থেকেই প্রতিবছর আয় হতে পারে কয়েক কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।

তিনি বলেন, শাপলা সংগ্রহে কোনো পুঁজির প্রয়োজন না হওয়ায় বিভিন্ন বয়সের কৃষকেরা বর্ষা মৌসুমকে ঘিরে এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। এছাড়াও প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলা লতায় আছে ৩১ গ্রাম শর্করা তিন গ্রাম প্রোটিন ও ৭৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। যা মানবদেহের জন্য খুবই উপকারী একটি সবজি।

প্রতিনিধি

Leave a Reply