মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি অযত্মে-অবহেলায় জবুথবু হয়ে আছে

শহরের মানিকপুর এলাকাস্থ মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি জেলা সদরের ৯ টি ইউনিয়ন ও ২ টি পৌরসভার লাখো মানুষের একমাত্র আশার আলো। ১০০ শয্যা বিশিষ্ট মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি বর্তমানে অযত্মে-অবহেলায় ও দেখাশোনার কেও না থাকায় কোন রকম জবুথবু হয়ে বেঁচে আছে। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স-এমনকি তৃতীয় শ্রেনীর কর্মকর্তাও। ৫০ শয্যার লোকবল দিয়েই চালানো হচ্ছে ১০০শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটি। বর্তমান সিভিল সার্জন বনদ্বীপ লাল দাস দুই-তিন মাসে একবারও দেখতে আসেননা কিঅবস্থায় রয়েছে এই হাসপাতাল ও এর চিকিৎসা সেবা। তিনি আছেন তার পকেট ভাড়ি করার চিন্তা নিয়ে।

বর্তমান আওয়ামীলীগে সরকারের গঠন করা স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদ-(স্বাচিব) এর কিছু দালাল-ডাক্তার নেতাদের নিয়ে তিনি এখন ধান্দা-ফিকির নিয়ে মহা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ঢাকায় নিজ বাড়িতে বসে থেকেই। গোটা জেলার বিভিন্ন কিনিক-ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারগুলো থেকে তিনি হাতিয়ে নিচ্ছেন হাজার হাজার টাকা। হাসপাতালে হাতে গোনা আউট-ডোরে দুই একজন ডাক্তার আসলেও বেশির ভাগ ডাক্তারই থাকে গড় হাজিরায়। প্রায় দুই মাস যাবত জেলা-শহরের প্রান কেন্দ্রে অবস্তিত এই হাসপাতালটিতে কোন প্রকার অপারেশন হচ্ছে না অজ্ঞানের ডাক্তার-এনেসথেসিয়ার-অভাবে। যার দরুন বাধ্য হয়ে গোলব্লাডার, পাইলস, টনসেল, সিজারসহ কোন প্রকার অপারেশনই হচ্ছেনা। সিভিল সার্জনকে এ বিষয়ে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করা হলেও তিনি সাংবাদিকদের জানান, অজ্ঞানের ডাক্তার এসেছে তার কর্মস্থলে যোগদান করে অপারেশন করা শুরু করা হয়েছে।

এদিকে অন্যান্য অপারেশন বিভাগের সার্জারী কন্সালটেন্ট মো:মেজবাহুল বাহার জানান, আমি অজ্ঞানের ডাক্তারের জন্য কোন প্রকার অপারেশন করতে পারছি না। এনেসথেসিয়ার ঐ ডাক্তারকে এখন পর্যন্ত ডাক্তার সহ তৃতীয় শ্রেনীর কোন কর্মকর্তাই এখন পর্যন্ত চোখে দেখেনি বলে জানান হাসপাতালের সকল ডাক্তার-ষ্টাফরা। অপারেশন না হবার দরুন দুর-দুরান্ত থেকে আসা গিরিব-অসহায় সিজারিয়ান সহ অপারেশনের রুগীরা বিপুল পরিমান টাকা খরচ করে দালালদের প্রলোভনের স্বীকার হয়ে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট কিনিকে অপারেশন করতে বাধ্য হচ্ছে।


এসব ব্যাপার সিভিল নার্জন জেনেও তার ভরুক্ষেপ নেই। সে আছে তার পকেট-আখের গোছানো নিয়ে। এ কারনে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা: এহসানুল করিম। তিনি বিলেন শুনেছি ডেপুটেশনে একজন এনেসথেসিয়া হাসপাতালে আনা হয়েছে কিন্তু তার রয়েছে মাত্র ৬ মাসের ট্রেনিং অভিজ্ঞতা। সে থাকলেই কি আর না থাকলেই কি। তাকে দিয়ে কোন কাজে আসবে না। এদিকে গাইনি কন্সালটেন্ট এনামুল ইসলাম ঐ অজ্ঞানের ডাক্তারের পক্ষে জোড়ালো সাফাই করছেন। তিনি এই প্রতিবেদকের সঙেগ কথা বলে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জরুরী বিভাগের দুর্নীতি-বানিজ্য:
জরুরী বিভাগে চিকিৎসা সেবা নামে প্রতিদিন চলে হাজার-হাজার টাকার বনিজ্য। এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কাছ থেকে টাকা ছাড়া কোন চিকিৎসাই হয় না। ডিউটিরত ব্রাদারদের সংগে সিন্ডিকেট তৈরী করে রোগীদের কাছ থেকে জোড় পুর্বক আদায় করা হয় টাকা। সেই টাকা হাতে পেলেই কর্তব্যরত ডাক্তার আসেন চিকিৎসা দিতে। সরকারি ভাবে জরুরী ইনজাকশন, ট্যাবলেট থাকা সত্তেও বাহিরে থেকে দামি ইনজাকশন-ট্যাবলেট আনতে রোগীদের চিরকোট ধরিয়ে দেন। পরে ভিতরের ওষূধ ব্যবহার করে রোগীকে ছেড়ে দিয়ে পরে রোগীদের মাধ্যমে কেনা ওষুধ বাহিরে বিক্রি করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার বানিজ্য করছে জরুরী বিভাগের ব্রাদার ও ডাক্তাররা।

ডাক্তারি সার্টিফিকেট বানিজ্য:
পুলিশি রিকুজিশন ছাড়া কোন সার্টিফিকেট দেয়া যাবে না। জেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংয়ে এমন সিন্ধান্ত থাকা সত্বেও জরুরী বিভাগে চলছে টাকার বিনিময়ে রিকুজিশন ছাড়া কোন সার্টিফিকেট বানিজ্য। তবে প্রকাশ্যে নয়। রাতের আধারে হাসপালের অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার ও ব্রাদারদের মাধ্যমে ডাক্তারের সাথে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ সার্টিফিকেট দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। ৮ জন ব্রাদারের মধ্যে সবাই এর সংগে জড়িত বলে একাধিক অভিযোগে জানা গেছে।


বহিরাগত বিভাগ:
হাসপালের বহিরাগত বিভাগটি চলছে মাত্র ৫ জন ডাক্তার দিয়ে এর মধ্যে ডাক্তার মো:তাজুল ইসলাম, মো:খালেকুজ্জামান, কামরুল করীম প্রতিদিন রোগী দেখছেন ৩ শতাধীকের উপরে। ওদিকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে সিনিয়র শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আশরাফুল ইসলাম, সার্জারি বিভাগের মেজবাহুল বাহার, ও গাইনি বিভাগে রয়েছেন ডা:এনামুল এর মধ্যে ডাক্তার এনামুল। আর বাকি যে ডাক্তার রয়েছেন তারা সবাই সকাল ৯ টার স্থলে আসেন ১১ টার দিকে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি ডাক্তার আলামিন প্রতিদিন বেলা ১১টার দিকে আসেন। পরে ১ঘন্টা কোন রকম ৫-১০জনকে আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ১২টার দিকে চলে যায় বাহিরের মডার্ন কিনিক ও ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারে। সেখানেই চলে তার মূল অর্থ-বনজ্যি। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা সাধারন অসহায় রোগীরা সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে নিয়োগকৃত দালালদের হস্থক্ষেপে চলে যায় প্রাইভেট কিনিকে। রোগীরা সেখানেও গিয়ে দেখে হাসপাতালের ডাক্তাররাই তাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন তার সাথে রোগীদের ধরিয়ে দিচ্ছেন রক্ত, এক্স-রে সহ নানান ধরনের পরিক্ষার ফর্দ।

ভর্তি-রোগীদের অবস্থা দুর্বিসহ:
জরুরী বিভাগ থেকে ভর্তি রোগীদের পোহাতে হচ্ছে দুর্বিসহ জীবন। কাগজে কলমে ১০০ শয্যা থাকলেও সরেজমিনে পাওয়া গেছে মাত্র ৮৯ টি সিট। বাকি সিট ওধাও হয়ে গেছে বলে জানান হাসপাতাল কতৃপক্ষ। অন্যদিকে সিট না থাকায় অপারগ হয়ে ৩০০ টাকা করে কেবিন ভাড়া করে থাকতে হচ্ছে অনেক রোগীদের। কিন্তু কেবিনের ভিতরে বাথরোম, আলো নাই, সময়মতো গুরুতর রোগীদের ডাক্তার দেখতে না আসায় রোগীরা এখন অতিষ্ঠ। সাধারন বেডেরও একই অবস্থা। রোগীদের সাথে শুয়ে থাকতে দেখা যায় কুকুর-বিড়ালদের। নোংড়া পরিবেশে থাকতে হচ্ছে তাদের। নারি, পুরুষ, ও শিশু বিভাগের সবকটিতেই একই চিত্র দেখা গেছে। জরুরী ওষুধ-পথ্য পাচ্ছে না রোগীরা। রোগীরা দরিদ্র বিধায় কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সদের অভিযোগ করেও কোন ফয়দা হচ্ছে না। উল্টো দুর্ব্যবহার করে রোগীদের চুপ করিয়ে দেয়া হয় ভর্তিকৃত রোগীদের। এখানে সিনিয়র নার্সরা উপস্থীত না থেকে নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারের জুনিয়র শিক্ষার্থীদের দিয়ে ডিউটি করাচ্ছেন। সিনিয়র নার্সরা হাজিরা দিয়েই চলে যায় বাড়িতে তাদের ব্যক্তিগত কাজে।

খাবারের মান:

৭০ টাকা করে রোগী প্রতি খাবারের বরাদ্ধ থাকলেও ভর্তি রোগীদের দেয়া প্রতিদিনের খাবারের মান খুবই নিন্মমানের দেয়া হয়ে থাকে। ডাক্তার-ঠিকাদারের যোগ-সাজসে এখানে প্রতিদিন বরাদ্ধকৃত খাবারে নিন্মমানের ভাত, ডাল, মাছ. ও সকালের মেনুতে নিন্মমানের রুটি-কলা ও দুধ দিয়েই চালানো হচ্ছে। গরিব রোগীরাও বাধ্য হয়ে সে খাবারই খাচ্ছে। আর খাবার চুরিতো রয়েছেই। সেখানেও কোন নজরদারি নেই কারও।

অপারেশন থিয়েটার:
প্রায় দুই মাস যাবৎ অপারেশন থিয়েটারটিতে তালা ঝুলছে। অজ্ঞানের ডাক্তার না থাকার কারনে এখানে কোন ধরনের অপারেশন হচ্ছেনা। তাই অপারেশন করতে আসা রোগীদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন সার্জারী ও গাইনি বিভাগের ডাক্তার। অপারগ হয়ে বাহিরের কিনিকে ও ঢাকায় বিপুল অর্থ ব্যয় করে বাধ্য হয়ে বিপুল পরিমানের টাকা খরচ করে অপারেশন করাতে যাচ্ছে। অজ্ঞান করা ছাড়া যেসব রোগীদের ছোট-খাটো অপারেশন করা হচ্ছে তাদের কাছ থেকেও গলা কেটে টাকা আদায় করছেন সিনিয়র সিসটাররা। এনারা ভেতরে সরকারি ওষুধ থাকা সত্বেও রোগেিদর বাহিরে থেকে ওষুধ আনিয়ে সরকারি ওষুধ দিয়ে কাজ করে। পরে কিনে আনা ওষুধ বাহিরের ফার্মেসিতে বিক্রি করে দেন।

ওষুধ কোম্পানি ও দালালদের দৌরাত্ত্ব :
একমাত্র হাসপাতালটিতে দিনের পর দিন ওষুধ কোম্পানি ও কিনিকের দালালদের দৌরাত্ব বেড়েই চলেছে। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধা পর্যন্ত চলে কিনিক-দালালদের পদচারনা। আর সকাল থেকে গভীর রাতঅব্দি চলে ওষুধ কোম্পানির নিয়োগকৃত দালালদের দৌরাত্ব। হাসপাতালে ঢুকলেই দেখা যায় রোগীদের চাইতে এই দুই সিন্ডিকেটের দালালদের। বিশেষ করে জরুরী বিভাগে নিন্মমানের ওষুধ কোম্পানির নিয়োগকৃত দালালরা হলুদ-সাদা খামে করে টাকা দিয়ে ডাক্তারদের ম্যানেজ করে তাদের কোম্পানির ওষুধ লেখাচ্ছেন। আর রোগীরা অপারগ হয়ে ঐ কোম্পানির ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছে।

অ্যাম্বুলেন্স সংকট :
রেফারকৃত জরুরী রোগীদের ঢাকায় নেয়ার জন্য ৩ টি অ্যাম্বলেন্সের স্থলে এখন মাত্র একটি অ্যাম্বলেন্স দিয়ে কোন রকম কাজ চারানো হচ্ছে। বাকি দুটির মধ্যে ১ টি পরে আছে নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে। আর বাকি ১টি বছরের পর বছর গ্যারাজে পরে আছে। বর্তমান সিভিল সার্জনকে অ্যাম্বুলেন্স সংকটের কথা বললেই প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, ডি.জি অফিসে চিঠি দেয়া হয়েছে সময় হলে অ্যাম্বুলেন্স পেয়ে যাবো।

সিভিল সার্জনের বক্তব্য :
জেনারেল হাসপাতালের এমন দুর্বিসহ করুন অবস্থার বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন বনদ্বীপ লাল দাস বলেন। সরেজমিনে হাসপাতাল না গেলে এসব তথ্যের বিষয়ে কিান সুরাহা করা যাবে না। ডাক্তাররা অসময়ে আসায় তাদের হাজিরা খাতা সিভিল সার্জন অফিসে এনে লাল কালি দিয়ে অনুপুস্থিত করা হয়েছে। আর পরিবেশ নোংরা, অপারেশন বন্ধ, খাবারে নিন্মমান, জরুরী বিভাগে ওষুধ ও সার্টিকিট বানিজ্যসহ অন্যন্য অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে বিভাগিয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

টাইমস্ আই বেঙ্গলী

Leave a Reply